সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থনা ও আল্লাহর নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ


সারকথা :

"আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, তারা বিশ্বাস করে যা আপনার উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা আপনার পূর্ববর্তীদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে। (কিন্তু) তারা বিরোধের বিষয়ে বিচারের জন্য তাগুতের মুখাপেক্ষী হয়, যদিও তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে একে (তাগুতকে) প্রত্যাখ্যান করতে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়।"
(সূরা নিসা, :৬০)

আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী : এখানে সাধারণ অর্থে সেসব মানুষকে বুঝানো হয়েছে, যারা নিজেদের হকপন্থী বলে দাবী করে, কিন্তু নিজেদের লাভের জন্য ন্যায়বিচারক নয়, এমন মানুষকে বিচারক মেনে নেয়।
ইমাম খোমেইনী : স্বৈরাচারী সরকারের বিচারব্যবস্থা, নির্বাহী ও রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গ মিলেই হলো "তাগুত"। কারণ তারা শয়তানি আইন তৈরী, প্রয়োগ এবং তাকে বিচারব্যবস্থার ভিত্তি করার মাধ্যমে ঐশী বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। এদেরকে অবিশ্বাস (প্রত্যাখ্যান) করতে আল্লাহ আমাদেরকে নির্দেশ করেছেন।
ুহাম্মাদ বিন আবদুল ওহাব : তাগুত ৫ প্রকার, এর মাঝে এক প্রকার হলো আল্লাহর আইন বিরোধী অত্যাচারী শাসক।

(আলোচনাটিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার স্বার্থে রেফারেন্সের ব্যক্তিগণকে (আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী, ইমাম খোমেইনী, মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওহাব) চিন্তার বাইরে রেখে কেবল বক্তব্যগুলিকে গ্রহণ করার অনুরোধ করছি।)

সুতরাং, কুরআনবিরোধী বিচারব্যবস্থা (judiciary) ও নির্বাহী (executive) মিলিয়েই হলো তাগুত। আর ইসলামবিরোধী এই জুডিশিয়ারি ও এক্সিকিউটিভ নিয়ে যে রাষ্ট্র, সেই "তাগুত" এর কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়াকে আল্লাহ তায়ালা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন (:৬০)

বিস্তারিত :

শুধু তা-ই নয়, এর ঠিক আগের আয়াত থেকে শুরু করে বিষয়টি নিয়ে আল্লাহ তায়ালা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
আল্লাহ প্রথমে সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতে বিশ্বাসীগণকে নির্দেশ দিয়েছেন যেনো তারা আল্লাহ, তাঁর রাসূল, এবং তাদের (বিশ্বাসীগণের) াঝে যারা বিচারক, তাদেরকে মান্য করে।
এরপর ৬০ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে বলছেন যে, অনেকেই আছে যারা নিজেদেরকে বিশ্বাসী বলে দাবী করে, অথচ তারা বিচার চাওয়ার জন্য আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও বিশ্বাসীগণের মাঝে যারা বিচারক, তাদেরকে ত্যাগ করে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হয়। একইসাথে আল্লাহ এ-ও বলে দিচ্ছেন যে, (তারা এমন করে, যদিও) তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করতে আল্লাহ তায়ালা বিশ্বাসীগণকে নির্দেশ দিয়েছেন।
লক্ষ্যনীয়, যারা এরূপ করে, আল্লাহ বলছেন যে, শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে চায় (:৬০)

যেসব বিশ্বাসী (জেনে বা না জেনে) তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হচ্ছে, যখন তাদেরকে বলা হয় যে আল্লাহ তো তাগুতের কাছে বিচার চাইতে নিষেধ করেছেন, বরং তোমরা কুরআন ও রাসূলের দিকে ফিরে আসো, তখন –
... আপনি (এদের মাঝে) মুনাফিকদেরকে দেখবেন তীব্র বিতৃষ্ণা সহকারে আপনার (এই আহবান) থেকে সরে যাচ্ছে।(সূরা নিসা, :৬১)
লক্ষ্যনীয় যে, তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থীদের মাঝে তারাই মুনাফিক, যাদেরকে সতর্ক করার পরও তারা তাগুতের কাছেই বিচার চায়। তবে সতর্ক করার পর যারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থনা করা থেকে ফিরে আসে, নিশ্চয়ই তারা মুনাফিক নয়। অর্থাৎ, যেসব বিশুদ্ধ হৃদয়ের বিশ্বাসীগণ আল্লাহর এই নির্দেশ না জেনে অজ্ঞতাবশতঃ তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হচ্ছিলো, তারা তখন ফিরে আসবে। তাগুতের কাছে তারা আর বিচারপ্রার্থনা করবে না; আল্লাহর নির্দেশ, রাসূলের আহবান মেনে নেবে। কিন্তু যেসব বিশ্বাসীর অন্তরে রোগ আছে, যারা নিজেদের দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিল করতে চায়, সেইসব বিশ্বাসী দাবীকারীরা (অর্থাৎ মুনাফিকেরা) তীব্র বিতৃষ্ণা সহকারে রাসূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। কুরআনের আয়াতকে অমান্য করবে এবং তাগুতের কাছেই বিচার প্রার্থনা করবে।

তো, আল্লাহ প্রথমে নির্দেশ দিলেন বিচারের ব্যাপারে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও বিশ্বাসীগণের মাঝে যারা বিচারক, তাদেরকে মান্য করতে (:৫৯)
তঃপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে চিনিয়ে দিচ্ছেন যে, দেখুন ! একদল লোক তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হচ্ছে, অথচ আমি (আল্লাহ) তো তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করতে বলেছি (:৬০)
রপর আল্লাহ বলছেন যে আপনি এই কথা বলে তাদেরকে সতর্ক করার পরও যারা কথা শুনছে না, তাগুতের কাছেই বিচারপ্রার্থী হচ্ছে, তারাই মুনাফিক, তাদের অন্তরই রোগগ্রস্ত (:৬১)

এরপর এজাতীয় কাজের ফলাফল সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে বলেছেন। আল্লাহ বলেন :
কেমন হবে, যদি (তাদের এসব) কৃতকর্মের ফলস্বরূপ তাদের উপর দুর্ভোগ নেমে আসে !...(সূরা নিসা, :৬২)
অর্থাৎ, দুনিয়ার মায়ায় পড়ে, দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সতর্কবাণী শোনার পরও তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হচ্ছে, আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করছে, এমন ব্যক্তিদের উপর থেকে যদি আল্লাহ করুণা উঠিয়ে নেন, আর যদি ফলস্বরূপ তারা দুর্দশায় পতিত হয়, তখন কী অবস্থা হবে !
একই আয়াতে দেখুন এসব কৃতকর্মের দরুণ দুর্দশায় পতিত হওয়া লোকেরা রাসূলের কাছে ফিরে এসে কী যুক্তি দিচ্ছে :
... তখন তারা আপনার কাছে ফিরে আসবে, আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলবে : কল্যাণ ও সম্প্রীতি ছাড়া আমাদের আর কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না।(সূরা নিসা, :৬২)

ারা এমন কাজ করবে, তাদের ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে জানিয়ে দিচ্ছেন পরবর্তী আয়াতে:
এরা হলো সেইসব লোক, যাদের মনের লুক্কায়িত বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ জানেন। সুতরাং তাদের বিরোধিতা করুন, তাদেরকে তিরস্কার করুন, এবং তাদেরকে এমন কথা বলুন, যা তাদের অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।(সূরা নিসা, :৬৩)

আল্লাহর সতর্কবাণী ও নির্দেশ, রাসূলের তিরষ্কার ও উপদেশ উপেক্ষা করার পরও পরম দয়ালু আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সুযোগ দিয়েছেন ক্ষমা প্রার্থনা করার। এতকিছুর পরও মানুষ যদি রাসূলের কাছে ফিরে এসে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চায়, রাসূলও যদি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহকে তারা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু হিসেবেই পাবে (সূরা নিসা, :৬৪)

কুরআনের সূরা নিসার ৫৯ থেকে ৬৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যে প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন, পরবর্তী আয়াতে সেই প্রসঙ্গের সূত্র ধরে এজাতীয় বিষয়কে ঈমানের পরীক্ষা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পুরো দৃশ্যটির দিকে আরেকবার আলোকপাত করলে :
আল্লাহ প্রথমে মানুষকে আদেশ করলেন বিচারকার্যে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও বিশ্বাসীদের মাঝে বিচারকগণকে মান্য করতে।
এরপর দেখা গেলো একদল বিশ্বাসী ব্যক্তি তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হচ্ছে।
তখন আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বললেন যে দেখুন তারা কিভাবে তাগুতের বিচারপ্রার্থী হচ্ছে, অথচ যদিও আমি তাদেরকে একাজ করতে নিষেধ করেছি, তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করতে বলেছি !
এরপর ভুলের মধ্যে পতিত সেই বিশ্বাসীদেরকে সতর্ক করার পর কেউ কেউ সঠিক পথে ফিরে এলো, তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করলো, তাগুতের কাছে আর বিচারপ্রার্থী হলো না। কিন্তু রাসূলের সতর্কবাণী সত্ত্বেও কিছু লোক নিজেদের দুনিয়াবী স্বার্থে তাগুতের কাছেই বিচাপ্রার্থী হতে লাগলো। তারা আল্লাহর নির্দেশকে অমান্য করলো। এজাতীয় লোককে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন মুনাফিক হিসেবে।
কিন্তু তবুও পরম দয়ালু আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ দিচ্ছেন, এবং বলছেন যে এতকিছুর পরেও যদি তারা ক্ষমাপ্রার্থনা করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমা করবেন।

এই দৃশ্যপট উপস্থিত করার পর এজাতীয় ঘটনাকে আল্লাহ তায়ালা ঈমানের পরীক্ষা হিসেবে উপস্থাপন করছেন পরবর্তী আয়াতে। সেখানে ঈমানের যে মূল বিষয়, অর্থাৎ আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন করা – সে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা একটি সামগ্রিক মানদণ্ড প্রদান করছেন। আল্লাহ তায়ালা বলছেন :
কিন্তু না ! আপনার প্রভুর কসম ! তাদের আসলে কোনো ঈমানই নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেদের বিরোধের বিষয়ে আপনাকে বিচারক মেনে নেয়। এবং (যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের) নিজেদের (অন্তরের) ভিতরে আপনার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আর কোনো বিতৃষ্ণা অনুভব করবে না, এবং পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করবে।(সূরা নিসা, :৬৫)

প্রসঙ্গত, ঈমান অর্থ নিরাপদকরণ। মুমিন, অর্থাৎ ঈমানদার অর্থ হলো নিরাপদকারী। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করে নিজেকে জাহান্নামের বিপদ থেকে নিরাপদ করে নিয়েছে। তো, যে ব্যক্তি মুখে নিজেকে বিশ্বাসী দাবী করছে, অথচ নিজের দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিলের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হচ্ছে, কিংবা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অন্য কোনো নির্দেশ অমান্য করছে, সে আসলে নিজেকে নিরাপদ করতে পারে নাই। কোনো না কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহ, কুরআন ও রাসূলের নির্দেশকে অমান্য করে সে নিজেকে অনিরাপদ করে ফেলছে। সে আর শাস্তির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না।
অর্থাৎ, যদিও সে নিজেকে মুখে মুমিন দাবী করে, তবুও আল্লাহর দৃষ্টিতে সে আসলে নিজেকে পরিপূর্ণ নিরাপদ করতে পারেনি। সে আল্লাহকে ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করার মাধ্যমে নিজেকে শাস্তির জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

একইসাথে "পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন", অর্থাৎ "ইসলাম” এর উপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার।
একজন মানুষ কখন পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করে ? একজন মানুষ কেবল তখনই পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করে, যখন সে বুঝতে পারে যে এই আত্মসমর্পন আমার জন্য কল্যাণকর। যেমন, ছোট একটি বাচ্চা তার সকল চাহিদার জন্য পিতা-মাতার কাছে ছুটে যায়, ভয় পেলে কিংবা অনিরাপদ বোধ করলে মায়ের কাছে ছুটে আসে। কারণ সেখানে সে নিরাপদ বোধ করে। তার এই আস্থা থাকে যে, কেউ আমার ক্ষতি করতে আসলে আব্বা-আম্মা আমাকে রক্ষা করবেন, আমি ভয় পেলে আমার ভয় দূর করবেন, নিরাপত্তা দান করবেন ইত্যাদি।
অনুরূপভাবে একজন মানুষ যখন তার স্রষ্টাকে যথাযথভাবে চিনতে পারে, বুঝতে পারে যে আসলে স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমেই আমি ইহকাল ও পরকালে নিরাপদ থাকতে পারবো, তখনই সে মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনকারী) হয়ে যায়, ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে মুখে মুসলিম দাবী করে, অথচ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কিছু নির্দেশ মানে ও কিছু নির্দেশ অমান্য করে, তাহলেই কিন্তু সে আর পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনকারী থাকলো না। সে হয়ে পড়লো আংশিক আত্মসমর্পনকারী, আংশিক মুসলিম।
জাতীয় ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা তিরস্কার করেছেন :
“… … ...। তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস করো এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস করো ! … … ...।” (সূরা বাকারা, :৮৫)
আসলে, এমন মানুষেরা দুনিয়ার মায়ায় জড়িয়ে পড়ার কারণে নিজেকে অনিরাপদ করে ফেলেছে, এবং জানা সত্ত্বেও আল্লাহকে পরিপূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরছে না, কুরআনকে পরিপূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরছে না। এই দুর্ভাগ্যজনক ও বিপদজনক অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো কুরআনের কাছে ফিরে যাওয়া, কোনোরূপ অসন্তোষ ছাড়াই একে পরিপূর্ণভাবে মেনে নেয়া, এবং আল্লাহ নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন বলতে কী বোঝায়, এ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা।

তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থনা করার প্রসঙ্গ নিয়ে মূল আলোচনা শুরু হলেও, যেহেতু মহান আল্লাহ তায়ালা এই দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ঈমানের প্রকৃত অর্থ ও পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনের মর্মার্থ বিষয়ে উসংহার টেনেছেন, সেহেতু "ইসলাম” ও "ঈমান" প্রসঙ্গেও কিছুটা আলোচনা করা হলো। আশা করি লেখাটি কেবল এই একটি দৃষ্টান্তের দিকে লক্ষ্য না করে সার্বিকভাবে ঈমান, অর্থাৎ নিজেকে "নিরাপদকরণ" ও ইসলাম, অর্থাৎ "পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ" বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে পাঠককে উদ্বুদ্ধ করবে।

মূল লেখা এখানেই শেষ। মূল প্রসঙ্গ, অর্থাৎ তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থনা প্রসঙ্গে কুরআনের আর দু-একটি আয়াত উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।
সূরা মায়েদা তে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন :
...যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই কাফের (:৪৪)। জালেম (:৪৫)। পাপাচারী (:৪৭)।”
কুরআনকে মুসলমানদের বিচারকার্যের মানদণ্ড হিসেবে ঘোষণা করে আল্লাহ তায়ালা রাসূলকে নির্দেশ করেছেন কেবল কুরআন অনুযায়ী-ই ফয়সালা করতে :
"আর আমি আদেশ করছি যে,আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন (অর্থাৎ কুরআন), তদনুযায়ী ফয়সালা করুন; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকুন – যেনো তারা আপনাকে এমন কোনো নির্দেশ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন। … … ..." (সূরা মায়েদা, :৪৯)
অর্থাৎ, প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে দুনিয়াবী লাভের জন্য মানুষ কুরআন ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে বিচার করলেও, তাগুতের কাছে বিচাপ্রার্থী হলেও, আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে সতর্ক করছেন যে, ঐসব লোকেরা যেনো আপনাকে কিছুতেই সৎপথ থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। আপনি যেনো কখনোই কুরআন ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ না করেন, এবং আপনি যেনো কখনোই তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী না হন।

লেখা এখানেই সমাপ্ত করছি। প্রার্থনা করছি যে, লেখাটি খোদাপ্রেমী মানুষকে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ, অর্থাৎ ইসলাম সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করবে।

নূরে আলম

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা