নবী
রাসূলগণ আজীবন নিষ্পাপ ছিলেন
কিনা, নিষ্পাপ
হলেও নির্ভুল ছিলেন কিনা,
এই মূল আলোচনা
শুরু করার জন্য যে গ্রাউন্ড
সেট (পটভূমি
বিস্তার) করা
প্রয়োজন, তাতেই
মূল প্রশ্নের উত্তর আলোচিত
হয়ে যাবে আশা করি।
প্রথম
প্রশ্ন হলো : নবী
কী ?
আলোচনা
শুরুর আগে মানুষ ও তার সৃষ্টিকর্তার
মাঝের সম্পর্ক ও বৈশিষ্ট্য
নিয়ে প্রথমেই সংক্ষেপে উল্লেখ
করা প্রয়োজন।
আল্লাহ
তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন
তাঁর ইচ্ছায় তাঁর সৃষ্টিক্ষমতার
স্বাধীন বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।
মানুষকে পৃথিবীতে থাকতে দেয়া
হয়েছে। পৃথিবীতে প্রতিটি
মানুষেরই জীবনকাল সীমিত।
এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা মানুষের
দুনিয়াবি জীবনে তার উপর বিভিন্ন
নিয়ম-নীতি
ও সীমা আরোপ করে দিয়েছেন,
যাকে সার্বিকভাবে
কার্যকারণবিধি (cause and
effect law, or, law of causality) বলা
যেতে পারে।
আল্লাহ
তায়ালা সকল পজিটিভ (গুণবাচক,
ধণাত্মক)
গুণের অধিকারী,
এবং “সীমা”
বিষয়টি তাঁর জন্যে প্রযোজ্য
নয়। অপরপক্ষে, মানুষ
“সৃষ্টি”, অর্থাৎ
সৃষ্টবস্তু (created) বলেই
সে সীমিত গুণবৈশিষ্ট্যের
অধিকারী। আল্লাহ মানুষকে
সীমিত পরিমাণে স্বাধীনতা
(অর্থাৎ
স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি অনুযায়ী
কাজ করার ক্ষমতা) দিয়েছেন।
এছাড়াও ভালো ও মন্দ বিচার করার
জন্য বিবেক দান করেছেন। মানুষ
তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি
ব্যবহার করে নানারকম কাজ করে
থাকে। যার মাঝে কিছু কাজ মানুষের
নিজের জন্য ও দুনিয়ার জন্য
কল্যাণকর, এবং
কিছু কাজ অকল্যাণকর। মানুষের
কল্যাণকর ভালো কাজগুলি আল্লাহ
তায়ালার পছন্দ, অপরপক্ষে
মানুষের খারাপ কাজগুলি আল্লাহর
অপছন্দ। মানুষ তার স্বাধীন
ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ ঘটাতে
গিয়ে ক্ষতিকর কাজ করে বসে,
সীমালঙ্ঘন
করে, বিবেকের
আদেশের বিরুদ্ধে কাজ করে বসে।
অপরপক্ষে, আল্লাহ
তায়ালা সকল পজিটিভ গুণের
অধিকারী হওয়ায় তিনি মানুষের
দেখাশোনা করেন, মানুষের
উপর দয়া করেন, এবং
একইসাথে মানুষকে এসকল ক্ষতিকর
কাজ থেকে রক্ষা করেন।
অর্থাৎ,
মানুষ নিজের
দোষে নিজেরই ক্ষতি করে বসে,
অপরদিকে
আল্লাহ তায়ালা দয়া করে দেখাশোনা
করে মানুষকে সেই ক্ষতি থেকে
রক্ষা করেন। আর আল্লাহ কর্তৃক
মানুষকে এসকল ক্ষতি থেকে রক্ষা
করার মাধ্যম হলো নবী – prophet
– পয়গম্বর।
সুতরাং,
নবী হলেন
সৃষ্টিকর্তার (আল্লাহর)
প্রেরিত/নির্বাচিত
এমন এক ব্যক্তি, যাঁর
দায়িত্ব হলো মানুষকে পথপ্রদর্শন
করা। এমন এক ব্যক্তি,
যার মাধ্যমে
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সঠিক
পথের দিশা দেন এবং পথচ্যুত
হওয়া থেকে সতর্ক করেন।
দ্বিতীয়
প্রশ্ন : নবীর
প্রয়োজনীয়তা কী ?
মানুষের
পথনির্দেশের প্রয়োজন হয় কেনো
?
প্রশ্ন
আসতে পারে যে, প্রতিটা
মানুষকেই আল্লাহ তায়ালা বিবেক
দান করেছেন। বিবেক ও বিচারবুদ্ধি
– এই দুটির সাহায্যেই তো মানুষ
ভালো মন্দ পার্থক্য করে সঠিক
পথে চলতে পারে। যে সে অনুযায়ী
চলবে না, সে
কষ্টের সম্মুখীন হবে,
শাস্তি ভোগ
করবে, আর
যে বিবেক-বিচারবুদ্ধি
অনুযায়ী চলবে, সে
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে
থাকবে, পুরস্কার
পাবে। তাহলে আর আলাদা পথনির্দেশের
(guidance, যেমন
কুরআন) প্রয়োজন
কী, আর
পথপ্রদর্শকেরই বা প্রয়োজন
কী।
এর
জবাব হলো, হ্যাঁ,
এটা সত্য
যে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যে
বিবেক ও বিচারবুদ্ধি দান
করেছেন, সে
অনুযায়ী না চলার কারণেই আল্লাহ
চাইলে শাস্তি দিতে পারেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ
তায়ালা মানুষকে সতর্ক করেন
(নবীর
মাধ্যমে) ও
পথনির্দেশ পাঠান (নবীর
কাছে গ্রন্থ পাঠানোর মাধ্যমে)।
এটা আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য
পজিটিভ গুণের কয়েকটির বহিঃপ্রকাশ।
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা কঠোর
নন, বরং
তিনি তাঁর সৃষ্টির প্রতি
দয়ালু। “পরম করুণা” (absolute
compassion) ও “পরম
দয়া” (absolute mercy) তাঁরই
গুণ। সুতরাং মানুষ ভুলবশত
পাপ করে বসলেও, প্রবৃত্তির
বশে সীমালঙ্ঘন করলেও আল্লাহ
তায়ালা তাঁর করুণা, দয়া
ইত্যাদি গুণের বহিঃপ্রকাশ
হিসেবে মানুষকে সতর্ক করে
দেন। তাকে চলার পথে আলো (গাইডেন্স)
দেন।
এটি
হলো একটি দৃষ্টিকোণ (perspective)।
আরেকটি পারস্পেক্টিভ হলো,
মানুষের
সকল কিছুর উপর তার নিজের হাত
থাকে না। যেমন, কোনো
মানুষের একটি পাপাচারী
সম্প্রদায়ের মাঝে জন্ম হতে
পারে। চারিদিকে অন্যায় অনাচার
পাপকর্ম দেখতে দেখতে ও তাতে
অংশ নিতে নিতে মানুষটি বড় হয়ে
ওঠে। এমনকি যৌবনপ্রাপ্ত হবার
আগেই চারিদিকের মানুষের
প্রভাবে সে অসংখ্য অন্যায়ে
লিপ্ত হয়ে পড়তে পারে। এসমস্ত
অন্যায় করতে করতে তার বিবেক
আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক
নয়। এমতাবস্থায় এটি তো তার
দোষ নয় যে তার জন্ম হয়েছিলো
পাপাচারী এক সম্প্রদায়ের
মাঝে ! সুতরাং,
দুর্বল
সৃষ্টি মানুষের পথনির্দেশ
পাবার চাহিদা চিরন্তন থেকেই
যায়।
আবার,
কেউ হয়তো
আশেপাশে কোনো পাপকাজ সংঘটিত
হতে দেখে। তা দেখে সে নিজেও
কৌতুহলবশতঃ পাপকাজটি করে
বসতে পারে। এ ধরণের কৌতুহল
মানুষের একটি দুর্বলতা। এছাড়াও
এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ আছে,
যা থেকে বোঝা
যায় যে, মানুষ
একটি দুর্বল ও অপূর্ণ সৃষ্টি।
চলার পথে আলো না থাকলে একা একা
সঠিকভাবে পথ চলা তার পক্ষে
খুবই কঠিন। সুতরাং সে সর্বদা
পথনির্দেশের মুখাপেক্ষী।
তৃতীয়
প্রশ্ন : নবী
চেনার উপায় কী ?
ধরুন
কোনো একটি পাপাচারী সম্প্রদায়ের
মাঝে পথপ্রদর্শক হিসেবে আল্লাহ
তায়ালা একজন নবীকে প্রেরণ/মনোনীত
করলেন। প্রশ্ন হলো, আমরা
তাকে শনাক্ত করবো কিভাবে ?
কারণ পার্থিব
যশ-খ্যাতি
ও ক্ষমতা ইত্যাদির লোভে অনেক
খারাপ মানুষ (ভণ্ড,
মুনাফিক)
নিজেকে নবী
দাবী করতে পারে, ইতিহাসে
করেছে, এবং
আজও করছে। তাহলে, এত
মানুষ যখন নিজেকে নবী দাবী
করছে ও অতীতে দাবী করেছে,
এদের মাঝে
আসল নবীকে চেনার উপায় কী ?
এখানেও
দুটি পারস্পেক্টিভ বিবেচ্য।
প্রথমত : নবী
যাদেরকে সতর্ক করতে এসেছেন,
সেই সম্প্রদায়ের
দৃষ্টিকোণ। সেই সমাজের কিছু
ব্যক্তি অন্যায় অনাচারের
সমাধান খুঁজতে থাকবে,
অর্থাৎ
পথপ্রদর্শকের সন্ধান করবে।
এক পর্যায়ে দেখবে যে অনেকেই
নিজেকে নবী দাবী করছে। এর মাঝে
তারা আসল পথপ্রদর্শক,
অর্থাৎ
সত্যিকারের নবীকে চিনে নেবে।
এই চেনার পন্থাটি কী হবে ?
অপরদিকে
নবীর পারস্পেক্টিভ হলো,
তিনি আল্লাহর
পক্ষ হতে নবুওয়্যাতের দায়িত্ব
পাওয়ার পরপরই পথপ্রদর্শনের
কাজে বেরিয়ে পড়বেন। অর্থাৎ
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নির্দেশ
করামাত্রই তিনি মানুষকে সচেতন
করা, সতর্ক
করা ও পথপ্রদর্শনের কাজ শুরু
করে দেবেন। এবং তাঁর আরও একটি
দায়িত্ব হলো নবী দাবীদার
ভণ্ডদের থেকে নিজেকে আলাদা
করা, যেনো
সাধারণ মানুষ খুব সহজেই তাকে
চিনে নিতে পারে। সুতরাং নবী
তার নিজের পক্ষ থেকে এমন কিছু
করবেন / বলবেন
/ দেখাবেন
যে, তাতে
মানুষ কোনোরকম সন্দেহ ছাড়াই
দেখামাত্র / শোনামাত্রই
তাঁকে চিনে ফেলবে যে – হ্যাঁ,
এই ব্যক্তিটিই
আল্লাহর প্রেরিত নবী। সুতরাং,
নবী তার
নিজের পক্ষ থেকেই এমন কোনো
বিষয় উপস্থাপন করবেন,
যা দ্বারা
তাঁকে শনাক্ত করা যায়। সেই
জিনিসটি / বিষয়টি
কী ?
এটিই
হলো মুজিজা, বা
অলৌকিক ঘটনা। অর্থাৎ,
নবী তার
নিজের সত্যতা প্রমাণের জন্য
যে প্রমাণ উপস্থাপন করবেন,
যে প্রমাণ
দেখে যেকোনো মানুষ কোনোরকম
সন্দেহ ছাড়াই তাকে আল্লাহর
নবী বলে চিনে ফেলবে, সেই
প্রমাণটিই হলো মুজিজা।
চতুর্থ
প্রশ্ন : মুজিজা
কী ?
নিজের
নবুওয়্যাত প্রমাণের জন্য
নবীগণ যে প্রমাণ উপস্থাপন
করে থাকেন, তা-ই
মুজিজা। আল্লাহর দেয়া বিশেষ
ক্ষমতাবলে নবীগণ এমন কিছু
কার্য সম্পাদন করেন যা সাধারণ
মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
কিংবা এমন কিছু জিনিস নিয়ে
আসেন, যা
কোনো মানুষের পক্ষে সৃষ্টি
করা সম্ভব নয়। যখন একজন নবী
মুজিজা উপস্থাপন করেন,
তখন “সর্বশক্তিমান
সৃষ্টিকর্তার দেয়া ক্ষমতা
ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে এটা
করা সম্ভব না” – এই অনুভূতি
থেকে মানুষ ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহর
মনোনীত/প্রেরিত
নবী হিসেবে মেনে নেয়। এটিই
মুজিজা।
পঞ্চম
প্রশ্ন : মুজিজাহ'র
বৈশিষ্ট্য কী ? মুজিজা
চেনার উপায় কী ?
মুজিজাহ'র
কিছু অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য
রয়েছে, যার
সবগুলিই নবীর আনা মুজিজায়
উপস্থিত থাকতে হবে। এর সাথে
নবীর নিজের বৈশিষ্ট্যও জড়িত
বটে। মুজিজার কিছু অপরিহার্য
বৈশিষ্ট্য হলো :
এক.
একে অলৌকিক
ঘটনা/বিষয়/বস্তু
হতে হবে। যেমন, এক
ব্যক্তি যেকোনো জায়গা থেকে
কিছুটা মাটি নিয়ে পাখির আকৃতি
তৈরী করলো, তাতে
ফুঁ দিলো, ওমনি
তা পাখি হয়ে গেলো। কোনো রোগীর
গায়ে হাত বুলানোমাত্র সে সুস্থ
হয়ে গেলো। হাত দিয়ে ইশারা
করামাত্র চাঁদ দুই টুকরা হয়ে
গেলো। বলামাত্রই পৃথিবীর
অন্যপ্রান্ত থেকে কোনো জিনিস
এনে হাজির করলো। লাঠি দিয়ে
আঘাত করামাত্র সাগরের মাঝে
রাস্তা তৈরী হয়ে গেলো,
ইত্যাদি।
এজাতীয় ঘটনা দেখে সাধারণ মানুষ
নিশ্চিত হলো যে, এগুলো
সেই মহান সত্ত্বা বিশ্বজগতের
সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়ই সম্ভব
হয়েছে, যিনি
স্বয়ং কার্যকারণ বিধির স্রষ্টা।
সুতরাং তাঁরই ইচ্ছায় প্রচলিত
কার্যকারণ বিধির বিপরীত ঘটনা
ঘটেছে, সমুদ্রের
পানি রাস্তার মত হয়ে গিয়েছে,
মাটির পুতুল
হয়ে গিয়েছে পাখি ইত্যাদি।
দুই.
মুজিজা
প্রদর্শনকারী ব্যক্তি পার্থিব
কোনো যশ-খ্যাতি-টাকা-পয়সা
ইত্যাদি আশা করবে না। কারণ
জাদুকর অনেকসময় বিস্ময়কর সব
কাজকর্ম করে দেখায়, কিন্তু
সে এর বিনিময়ে টাকা পয়সা চায়,
বিখ্যাত
হতে চায়, ক্ষমতাশালী
হয়ে মানুষের উপর খবরদারী করতে
চায় ইত্যাদি। কিন্তু একজন
নবী যখন মুজিজা প্রদর্শন
করবেন, তখন
সাধারণ মানুষ ভাববে : এই
লোকতো বিখ্যাত হওয়ার জন্যও
কাজটি করেনি, আবার
আমাদের কাছে টাকাও চাইছে না
– আসলে এই লোকতো দুনিয়াবি কোনো
কিছুই চাইছে না এই বিস্ময়কর
সব মুজিজাহ'র
পরিবর্তে; তাহলে
সে নবী না হয়েই পারে না !
তিন.
যে বিষয়ে
মুজিজা প্রদর্শন করবে,
সেই বিষয়ে
কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা /
কাজ করার
ইতিহাস থাকবে না। যেমন,
একজন ডাক্তার,
যে কিনা
সারাজীবন মানুষের রোগ নিরাময়
নিয়ে জ্ঞান গবেষণা করে এসেছে,
মানুষকে
চিকিৎসা দিয়ে এসেছে, সে
যদি হঠাৎ করেই একদিন নিজেকে
নবী দাবী করে এবং বলে যে :
এই দেখো আমি
এই মানুষের গায়ে হাত বুলিয়ে
দিলাম আর ওমনি তার চর্মরোগ
সেরে গেলো – তাহলে মানুষ তাকে
সন্দেহ করবে। কারণ হয়তো সারাজীবন
ডাক্তারি বিদ্যা চর্চা করতে
করতে সে এখন এমন এক ওষুধ আবিষ্কার
করেছে, যেটা
নিজের হাতের তালুতে লাগিয়ে
চর্মরোগ সারিয়ে দিচ্ছে
মুহুর্তেই। এমন হলে লোকে তাকে
বিশ্বাস করবে না। সুতরাং,
কোনো নবী
যদি এমন মুজিজা উপস্থাপন করেন,
সেক্ষেত্রে
ঐ নবীর জীবনে ডাক্তারির কোনো
ইতিহাস থাকতে পারবে না। সুতরাং,
এমন মুজিজার
উপস্থাপনকারী ব্যক্তিকে
সাধারণ মানুষের মাঝে এইভাবে
চেনা থাকতে হবে যে : “এই
লোক রোগ বালাই দূর করা সম্পর্কে
কিছুই জানে না।”
চার.
যে সমাজে
মুজিজাহ প্রদর্শন করা হচ্ছে,
সেই সমাজে
ঐ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির
উপস্থিতি অপরিহার্য। যেমন,
কোনো সমাজ
যখন সাহিত্যের চরম শিখরে
পৌঁছলো, এবং
দুনিয়ার সকল ভাষাবিদ ও অন্যান্য
সকল ভাষার সাহিত্যিকেরাও এই
সমাজের সাহিত্যিকদের কাছে
হার মানলো, সেই
সময়ে নিতান্তই লেখাপড়া না
জানা অসাহিত্যিক এক ব্যক্তি
এমন এক সাহিত্যকর্ম উপস্থাপন
করলো, যা
দেখে ঐ সমাজের শ্রেষ্ঠ
সাহিত্যিকেরা হতভম্ব হয়ে
পড়লো, কিংকর্তব্যবিমূঢ়
হয়ে পড়লো এবং ঐ সাহিত্যকর্মকে
মানুষের সৃষ্টির উর্ধ্বে
স্রষ্টার বাণী হিসেবে স্বীকার
করে নিলো।
নবীর
অন্যতম অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য
: পাপমুক্ততা
প্রথমেই
“পাপ” এর সংজ্ঞায়ন জরুরি।
পাপ হলো এমন কথা-কর্ম-চিন্তা,
স্বচ্ছ বিবেক
যার বিরুদ্ধে রায় দেয়। পাপ
হলো এমন কথা-কর্ম,
যা সমাজে
খারাপ বলে পরিগণিত। এমনসব
কথা-কর্ম,
যা অন্যের
উপর প্রয়োগ করা হলে তারা কষ্ট
পায়। মানুষের যেকোনো আল্লাহ
প্রদত্ত হক নষ্ট করা এবং দুনিয়ায়
এমন কাজ করা, যার
জন্য আল্লাহ তায়ালা শাস্তি
ঘোষণা করেছেন, তা-ই
পাপ। “পাপ” এর সাথে “ভুল” এর
সূক্ষ পার্থক্য বিদ্যমান,
যা সামনে
আলোচনা করা হবে। তবে সংক্ষেপে
বলতে গেলে চুরি, ডাকাতি,
খুন,
আমানতের
খিয়ানত করা, কারো
সম্পত্তি নষ্ট করা, কাউকে
মন্দ কথা বলা ইত্যাদি অনেক
কিছুই পাপ। মোটকথা ভ্রান্তিহীন
স্বচ্ছ বিবেক যার বিরুদ্ধে
রায় দেয়, তা-ই
পাপ।
নবীর
অন্যতম অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য
হলো পাপমুক্ততা। একজন নবীকে
অবশ্যই শতভাগ পাপমুক্ত থাকতে
হবে। এই পাপমুক্ততা তিনটি
দৃষ্টিকোণ থেকে অপরিহার্য।
এক.
আল্লাহ
তায়ালার দৃষ্টিকোণ থেকে পাপ
কাজ, এমন
কোনো কাজেই নবী তাঁর জীবনে
কখনোই লিপ্ত হবেন না।
দুই.
নবীর বিবেক
সর্বদা শতভাগ স্বচ্ছ,
এবং এই স্বচ্ছ
বিবেক যার বিরুদ্ধে রায় দেয়,
এমন কোনো
কাজ তিনি তাঁর গোটা জীবনে
কখনোই করবেন না।
তিন.
আল্লাহ ও
তাঁর নবী ব্যতীত তৃতীয় যে
পক্ষ, অর্থাৎ
যাদের কাছে পথনির্দেশ দেয়া
হচ্ছে, নবী
যাদেরকে সতর্ক করছেন কিংবা
ভবিষ্যতে করবেন, সেই
মানুষগণের কাছেও পাপ বলে
বিবেচিত হয়, এমন
যেকোনো কাজ থেকে নবী তাঁর গোটা
জীবনেই বিরত থাকবেন।
আল্লাহ
তায়ালা যেটাকে পাপ বলে গণ্য
করেন, তেমন
কাজে একবারও লিপ্ত হয়েছে,
এমন ব্যক্তিকে
তিনি নবুওয়্যাতের জন্য মনোনীত
করবেন না। বরং তিনি আদর্শ
হিসেবে শতভাগ নিষ্পাপ মানুষকেই
মনোনীত করবেন। এটা বিচারবুদ্ধির
দাবী। যাকে আল্লাহ তায়ালা
স্বয়ং অনুসরণ করতে আদেশ করবেন,
সেই মানুষের
ছোট একটি-ও
ত্রুটি থাকবে, এটা
হতে পারে না। তাহলে সেই ছোট
একটি ত্রুটিই কোটি কোটি মানুষ
অনুসরণ করে দুনিয়ায় ফাসাদ
সৃষ্টি করবে। আর এটাও হতে পারে
না যে নবী একটি ছোট পাপ করলেন,
অতঃপর তাঁর
সকল অনুসারীও সেই পাপ কাজটি
করলো, পরবর্তীতে
আল্লাহ তায়ালা নবীকে সংশোধন
করে দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে
তো হাজার হাজার কোটি কোটি
মানুষ একটি পাপ করে ফেলেছে।
অথচ নবী পাঠানোর মূল উদ্দেশ্যই
হলো মানুষকে ভুল-ভ্রান্তি
ও ক্ষতিকর কাজ থেকে রক্ষা করা
(শুরুতে
আলোচনা করা হয়েছে)।
নবী যদি একটি ছোট পাপও করেন,
তাহলে সেটার
অনুসরণে যখন কোটি কোটি মানুষের
পাপকাজে লিপ্ত হবার আশঙ্কা
রয়েছে, সেক্ষেত্রে
আল্লাহ তায়ালা নবীকে পাপ কাজ
করতে দেবেন, এটা
হতে পারে না। তাহলে নবুওয়্যাতের
মূল লক্ষ্যই ব্যর্থ হয়ে পড়ে।
নবুওয়্যাত, অর্থাৎ
“মানুষকে পাপ ও ক্ষতিকর কাজ
থেকে রক্ষা করা”-ই
যার দায়িত্ব, সে
কী করে উল্টা মানুষকে পাপকাজে
লিপ্ত করবে ! এতো
অসম্ভব ! তাও
আবার আল্লাহর পক্ষ থেকে !
এটা কী করে
সম্ভব যে আল্লাহ তায়ালা গোটা
মানবজাতিকে আদেশ করবেন কোনো
ব্যক্তির অনুসরণ করতে,
অথচ তার মাঝে
ক্ষুদ্রতম হলেও একটি পাপকাজ
থাকবে ! বরং
আল্লাহ তায়ালা তো শতভাগ বিশুদ্ধ
মানুষকেই মনোনীত করবেন। সুতরাং
আল্লাহ তায়ালা শতভাগ নিষ্পাপ
মানুষকেই নবুওয়্যাতের জন্য
মনোনীত করবেন, যিনি
আল্লাহর জমীনে মানুষকে ক্ষতি
থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব শতভাগ
পালন করবেন – এটাই বিচারবুদ্ধির
দাবী।
নবী
তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকেও
নিজের পাপমুক্ততার ব্যাপারে
শতভাগ নিশ্চিত থাকবেন। একটু
আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে
আল্লাহ তায়ালা এমন ব্যক্তিকেই
পথপ্রদর্শনের জন্য মনোনীত
করবেন, যিনি
সারাজীবন শতভাগ নিষ্পাপ
থাকবেন। তাঁর বিবেক থাকবে
শতভাগ স্বচ্ছ। কোনো প্রকৃত
পাপকাজকে তিনি ভুলেও ভালো
কাজ বলে মনে করবেন না। একজন
সাধারণ মানুষের কাছে আগুন ও
পানির মন্দ ও ভালো দিক যতটা
পরিষ্কার, তাঁর
কাছে পাপ ও পুন্য কাজ-ও
ততটাই পরিষ্কার ব্যাপার থাকবে।
বরং তার চেয়েও বেশি পরিষ্কার
থাকবে। যেকোনো মন্দ কাজ ও ভালো
কাজ, তা
সেটা শনাক্ত করা সাধারণ মানুষের
পক্ষে যতই কঠিন হোক না কেনো,
নবী তা
দেখামাত্র বুঝতে পারবেন,
হোক সেটা
নবুওয়্যাতের আগে কিংবা পরে।
এছাড়াও নবী নিজেই নিশ্চিত
থাকবেন যে তিনি জীবনে কখনোও
কোনো পাপ কাজ করেননি। তাঁর
এই পাপমুক্ততা ও দুনিয়াবি
স্বার্থের প্রতি নিরাসক্তি
সর্বদা বিরাজমান থাকবে।
এমতাবস্থায় নবুওয়্যাতের
দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথে এ
বিষয়ে তাঁর মনে কোনোরূপ সন্দেহ
জাগবে না। তিনি সাথে সাথে
বুঝতে পারবেন যে আল্লাহর পক্ষ
থেকে তিনি মনোনীত হয়েছেন।
এবং কোনোরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব
ছাড়াই তিনি দায়িত্ব পালন শুরু
করবেন। কারণ এ ব্যাপারে তিনি
অতি স্পষ্ট থাকবেন।
একজন
সাধারণ পাপ-পুণ্যকারী
মানুষ হলে তার মনে এমন আশঙ্কা
জাগবে যে : নবুওয়্যাতের
দায়িত্ব পাওয়া – ওগুলো সব
রাতের স্বপ্ন। একথা ভেবে
পার্থিব দুনিয়ায় ফিরে যাওয়াটাই
তার পক্ষে স্বাভাবিক হবে।
অপরপক্ষে সারাজীবন নিষ্পাপ
জীবন যাপন করা ব্যক্তি,
এবং তিনি
পার্থিব দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তও
বটে – এমন ব্যক্তি যখন নবুওয়্যাতের
দায়িত্ব পান (ধরুণ
ফেরেশতার মাধ্যমে), তখন
সাথে সাথেই সেই দায়িত্ব পালনে
নেমে পড়তে তাঁর কোনো বাধাই
আসে না। শতভাগ নিষ্পাপ ব্যক্তিই
কেবল দুনিয়ার প্রতি শতভাগ
নিরাসক্ত হতে পারে, আর
তাই স্রষ্টার আদেশ পাওয়ামাত্র
সে আদেশ পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এ ব্যাপারে তার মনে ন্যুনতম
সন্দেহ-ও
থাকে না।
অর্থাৎ,
নবীর পাপমুক্ততা
তাঁর নিজের কাছেও অতি স্পষ্ট
থাকতে হবে।
এছাড়াও,
নবী যদি
নিজের কাছেই মনে করে থাকেন
যে তিনি কোনো পাপ করেছেন তাঁর
জীবনে, তাহলে
ধর্ম প্রচারের সময় তাঁকে সেই
সত্যটা গোপন রাখতে হবে। এমনকি
যদি কোনোদিন কেউ জিজ্ঞাসাও
করে বসে যে : আচ্ছা,
তুমি কি কখনো
ওমুক (পাপ)
কাজটি করেছো
? আর
যদি তিনি সত্যিই মনে করে থাকেন
যে তিনি ঐ পাপ কাজটি করেছেন,
তাহলে হয়
তাঁকে সেটা স্বীকার করতে হবে,
নয়তো গোপন
করতে হবে। স্বীকার করলেই লোকে
আর তাঁকে নবী হিসেবে মানবে
না। আর গোপন করলে তিনি নিজেই
মিথ্যাবাদীতার দোষে দুষ্ট
হয়ে পড়বেন। সারাজীবন একটি
বিষয়ে বারবার মিথ্যা বলবেন।
অথচ মিথ্যা বলাসহ অন্যান্য
পাপকাজ থেকে মানুষকে রক্ষা
করতেই তাঁর আগমন ! সুতরাং,
নবী নিজের
কাছেও শতভাগ পরিষ্কার থাকবেন
যে তিনি নিষ্পাপ একজন ব্যক্তি।
সেটা এমনকি নবুওয়্যাতের আগেও।
তৃতীয়
যে পক্ষ, অর্থাৎ
যাদের উদ্দেশ্যে নবী প্রেরণ/মনোনীত
করা হয়েছে, তারাও
ঐ ব্যক্তির পাপমুক্ততার
ব্যাপারে নিঃসন্দেহ থাকবে।
নবী
শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চয়ই এমন
হবে না বিশেষজ্ঞদের একটি টিম
নবী দাবীকারী ব্যক্তির অতীত
ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবে,
তার চলাফেরা
পর্যবেক্ষণ করবে, তার
উপদেশবাণী নিয়ে পর্যবেক্ষণ
বিশ্লেষণ করবে, তারপর
সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণকে জানিয়ে
দেবে যে : হ্যাঁ,
এই ব্যক্তিই
নবী, কিংবা
না, এ
নবী নয়। বরং নবী শনাক্ত করতে
পারার বিষয়টি সর্বজনীন হতে
হবে। সুতরাং, একজন
সম্পূর্ণ অশিক্ষিত ব্যক্তিও
যেমন নবীকে শনাক্ত করতে সক্ষম
হবে, তেমনি
সমাজের দশ দিগন্তের পড়াশুনা
করা সবচে' জ্ঞানী
মানুষটিও তাকে দেখলেই শনাক্ত
করতে পারবে। অর্থাৎ, নবী
চেনার উপায়গুলো সর্বজনীন হতে
হবে। একারণে নবীর উপস্থাপিত
মুজিজা যেমন সবচেয়ে জ্ঞানী
থেকে সবচেয়ে মূর্খ সকল মানুষকেই
বিস্মিত করে, এবং
তারা বুঝতে পারে যে আল্লাহর
কুদরত ছাড়া এটা সম্ভব নয়,
তেমনি নবী
চেনার অপর উপায়, পাপমুক্ততাও
সকলের পক্ষে সহজেই শনাক্তকরণযোগ্য
হবে। অর্থাৎ ছোট শিশু,
বৃদ্ধ,
জ্ঞানী,
মূর্খ,
অনাচারী-পাপাচারী
– অর্থাৎ সমাজের সর্বস্তরের
মানুষই নবী দাবীকারী ব্যক্তিটিকে
নিষ্পাপ বলে জানবে। তা সেটা
নবুওয়্যাত দাবীর আগে হোক কি
পরে হোক, আর
লোকেরা মুখে স্বীকার করুক আর
না করুক। অন্তরে ঠিকই স্পষ্ট
জানতে পারবে যে : হ্যাঁ,
এই ব্যক্তিটির
মুজিজা-ও
যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে,
তেমনি এই
ব্যক্তিটি আজীবন নিষ্পাপই
ছিলো – সুতরাং এ-ই
আল্লাহর মনোনীত নবী।
…....................
বিরতি......................
এখানে
একটু থামা প্রয়োজন। এ পর্যন্ত
কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে
এবং ধাপে ধাপে শেকড় থেকে শিখরে
যাবার পদ্ধতি অনুসরণ করে নবী
প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা থেকে
শুরু করে নবী চেনার উপায় পর্যন্ত
আলোচনা করা হয়েছে। যে বিষয়গুলো
আলোচনা করা হয়েছে তা হলো :
নবী
কী ?
নবীর
প্রয়োজনীয়তা কী ?
মানুষের
পথনির্দেশের প্রয়োজন হয় কেনো
?
নবী
চেনার উপায় কী ?
মুজিজা
কী ?
মুজিজাহ'র
বৈশিষ্ট্য কী ?
মুজিজা
চেনার উপায় কী ?
এবং
নবীর অন্যতম অপরিহার্য
বৈশিষ্ট্য, পাপমুক্ততা
নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
নবী
চেনার উপায় শিরোনামের আলোচনা
এ পর্যন্ত সমাপ্ত হলো। পরবর্তী
অংশে একটি বহুল বিতর্কিত বিষয়,
“নবীগণ
ভুল-ত্রুটির
উর্ধ্বে ছিলেন কিনা”,
তা নিয়ে
আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু
যেহেতু পরবর্তী আলোচনাটি
পূর্ববর্তী আলোচনার উপর ভিত্তি
করে করা হয়েছে, সেহেতু
“নবী চেনার উপায়” শিরোনামে
উপস্থাপিত যুক্তিগুলোতে একমত
না হয়ে পরবর্তী আলোচনায় না
যাওয়াই সঙ্গত। অর্থাৎ,
নিচে উপস্থাপিত
“নবীগণ কি ভুল-ত্রুটির
উর্ধ্বে ছিলেন” শিরোনামের
আলোচনাটি কেবল তাদের জন্যই
প্রযোজ্য ও ফলপ্রসু,
যারা “নবী
চেনার উপায়” শিরোনামের আলোচনায়
উপস্থাপিত যুক্তিগুলোর সাথে
একমত হয়েছেন।
…..........................................................
নবীগণ
কি ভুল-ত্রুটির
উর্ধ্বে ছিলেন ?
“ভুল”
ও “পাপ” এর মধ্যে পার্থক্য
বিদ্যমান। পাপের জন্য আল্লাহ
তায়ালা শাস্তি নির্ধারণ
করেছেন। অপরপক্ষে,
সাধারণভাবে
“ভুল” এর জন্য আল্লাহ তায়ালা
শাস্তি নির্ধারণ করেন নাই।
যেমন একজন মানুষ রোজারত অবস্থায়
ভুল করে কিছু খেয়ে ফেলতে পারে।
এতে পাপ নেই। আবার, বাড়ি
ফিরতে গিয়ে ভুলবশতঃ অন্যের
দরজায় নক করে বসতে পারে। এই
ভুলে কোনো পাপ নেই। তবে কিছু
কিছু ভুল কাজ পাপে পরিণত হয়,
কিংবা পাপে
পর্যবসিত হয়। যাহোক সেটা অন্য
আলোচনার বিষয়। যেহেতু নবীগণের
নিষ্পাপতার বিষয়টি নিশ্চিত
সেহেতু আমরা এখন তাঁদের ভুল
হয় কিনা বা হয়েছে কিনা,
তা নিয়ে একটু
বিশ্লেষণ করবো।
খুব
সংক্ষেপে বলতে গেলে,
একটি উদাহরণ
বিবেচনা করা যেতে পারে। ধরুন
পিতা নামাজে একটি ভুল করলো,
আর তা দেখে
দেখে পুত্র-ও
সেই একটি ভুল করলো। এক্ষেত্রে
পিতার পাপ হয়েছে কি ?
নিশ্চয়ই না
! এটা
অনিচ্ছাকৃত ভুল। আর পিতা
পরবর্তীতে যেকোনো দিন পুত্রকে
সংশোধন করে দিলেই হলো। কিন্তু
চিন্তা করে দেখুন, একজন
নবীর ইমামতিতে অসংখ্য লোক
নামাজ আদায় করছে প্রতিদিন।
নবীর সাথে পিতার অনেক পার্থক্য।
নবীর সকল কর্মকাণ্ড হুবহু
অনুসরণযোগ্য। তাঁর সকল আদেশ
শিরোধার্য। এমতাবস্থায় নবী
নামাজে একটি ভুল করলেন। হতে
পারে কেবল ঐদিনই দূরদেশ থেকে
আসা এক লোক নবীর পিছনে নামাজ
আদায় করছিলো। সে-ও
ঐ ভুলটি অনুসরণ করলো,
এবং ফিরে
গিয়ে তার দেশের লোকেদেরকে ঐ
ভুল নামাজই শিক্ষা দিলো। এভাবে
করে নবীর একটি ভুল অনুসরণ করে
লক্ষ থেকে কোটি কোটি মানুষ
ভুলে পতিত হলো।
অথচ
নবী প্রেরণের মূল লক্ষ্য কী
ছিলো ? মানুষকে
সতর্ক করা। মানুষ যেনো
অজ্ঞতা-অসাবধানতাবশতঃ
নিজের ও অন্যের ক্ষতিসাধনে
লিপ্ত না হয়, সেজন্যে
পথপ্রদর্শন করা। স্বয়ং আল্লাহ
যাকে অনুসরণযোগ্য করে দিয়েছেন,
সেই মানুষটি
কি এমন কোনো ভুল করতে পারেন,
যার অনুসরণ
হাজার লাখো কোটি মানুষ করবে
? আর
বিষয়টি কেমন হবে, যদি
এরপর নবী বলেন যে ঐদিন আমি ভুল
করেছিলাম, আসলে
নামাজ হবে এইরকম ! তাহলে
মানুষের আস্থা কোথায় যাবে !
মানুষ মনে
করবে যে, এই
লোককে অনুসরণ করছি, অথচ
সে আজকে বলে নামাজ এরকম,
কালকে হয়তো
বলবে আরেক রকম !
অর্থাৎ,
এই দৃশ্যপট
(scenario) থেকে
এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে,
যাঁকে হাজার
লাখো কোটি মানুষ অনুসরণ করছে
এবং করবে, সেই
নবী কখনো এমন কোনো ভুল করতে
পারেন না, যেটা
মানুষের জন্য অনুসরণযোগ্য
বিষয়। অর্থাৎ, ইবাদত,
আচার-ব্যবহার,
শিষ্টাচার,
ন্যায়বিচার
ইত্যাদিসহ একজন নবীর যত বিষয়
তাঁর অনুসারীরা অনুসরণ-অনুকরণ
করতে পারে এবং করবে, সেসব
বিষয়ে পাপের তো প্রশ্নই আসে
না, এমনকি
ক্ষুদ্রতম ভুলও করবেন না নবী।
এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী।
সুতরাং,
এই সিদ্ধান্তে
আসা যায় যে, একজন
নবী এমন বিষয়ে কোনো ভুল করতে
পারেন না, যা
তাঁর অনুসারীগণ অনুসরণ করবে
(পার্থিব
ও আধ্যাত্মিক উভয় প্রকার
অনুসরণযোগ্য বিষয়েই)।
অর্থাৎ অনুসরণ-অনুকরণের
বিষয়ে নবী কখনোই কোনো ভুল
করবেন না। এতে বিভ্রান্তি
সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যাবে।
এটিই বিচারবুদ্ধির দাবী।
একজন
নবীর ক্ষেত্রে আর দু-প্রকার
ভুল থাকতে পারে। এক.
যেটা অনুসারীদের
জন্য অনুসরণযোগ্য নয়,
এবং কেউ তা
দেখেও নি, দেখবেও
না এবং দেখলেও অনুসরণ করবে
না। যেমন একটি কাগজ তুলতে গিয়ে
ভুলবশতঃ দুটি কাগজ তুলে ফেলা,
একটি বীজ
ফেলতে গিয়ে ভুলবশতঃ দুটি বীজ
মাটিতে ফেলা, কোনো
কাঁটাঅলা গাছ ধরতে গিয়ে ভুলবশতঃ
কাঁটায় স্পর্শ করে ফেলা...
এজাতীয় ভুল
হওয়া সম্ভব। তবে নবীগণের
এজাতীয় ভুল হয়েছেই, বা
হতেই হবে, এমনটাও
বাধ্যতামূলক নয়।
দুই.
শুধুমাত্র
আল্লাহর কাছে কৃত ভুল। এটি
নবীগণের সাথে আল্লাহ তায়ালার
বিশেষ সম্পর্কের শিরোনামে
আলোচিত বিষয়। এটি মানুষের
বুঝের মধ্যে খুব কমই ব্যাখ্যাযোগ্য।
তবুও, যেমন
আল্লাহর নবী তাঁর জনপদের
অনাচার দেখে এবং সত্য বিমুখতা
দেখে খুব কষ্ট পেয়ে দূরে কোথাও
আশ্রয় নিলেন। অতঃপর আল্লাহ
তায়ালা তাকে তার হৃদয় প্রশান্ত
ও দৃঢ় করার জন্য প্রার্থনা
শিক্ষা দিলেন এবং তাকে অধিকতর
বিশুদ্ধ করে তার জনপদের কাছে
ফেরত পাঠালেন। এই ঘটনাকে সেই
জনপদের কাছেও ভুল বলে মনে হবে
না। এটা কেবল স্রষ্টার সাথে
তাঁর অতি প্রিয় বিশুদ্ধ বান্দার
বিশেষ সম্পর্ক, যেটাকে
আমরা সাধারণ মানুষেরা আমাদের
সীমিত ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে
“ভুল” শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত
করছি। প্রকৃতপক্ষে এই “ভুল”
এবং আমাদের সাধারণ মানুষের
মাঝে যেটা “ভুল” বলে পরিচিত,
তা এক নয়।
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই
বিষয়টা বোঝা যায়।
সাধারণ
মানুষের ভুল, যা
সবার কাছে প্রকাশ্য ও যা অন্যদের
জন্য অসুবিধা / বিভ্রান্তির
সৃষ্টি করে, সেই
“ভুল” এর সাথে নবীগণের “ভুল”কে
এক কাতারে চিন্তা করায় এই
সমস্যা হয়েছে। বরং নবীগণের
এসব বিষয় মহান আল্লাহ তায়ালার
সাথে তাঁদের বিশেষ সম্পর্কের
অধীন বিষয়, যা
আমাদের সীমিত ভাষায় প্রকাশ
করা কঠিন।
একটি
উল্লেখযোগ্য বিষয়। নবীগণের
পাপ, ভুল
ও সীমালঙ্ঘন করার ক্ষমতা আছে,
কিন্তু তারা
সেটা ব্যবহার করেন না। অপরপক্ষে
ফেরেশতাগণের সেই ক্ষমতাই
নেই। কুরআন শরিফে বিবৃত আছে
যে, কাফিররা
বলতো : এ
কেমন নবী যে হাট-বাজারে
যায়, রাস্তায়
চলাফেরা করে, খাবার
খায়...।
বরং একজন ফেরেশতা আসলেই পারে।
অথচ
যেহেতু ফেরেশতাদের সেই ক্ষমতাই
নেই, সেহেতু
আল্লাহ তায়ালা একজন মানুষকে
অনুসরণীয় (অর্থাৎ
পথনির্দেশক, নবী)
করে পাঠিয়েছেন,
যেনো সাধারণ
মানুষ এটা বুঝতে পারে যে,
মানুষ হয়েও
নিষ্পাপ ও নির্ভুল থাকা সম্ভব।
খারাপ কাজ করার ক্ষমতা থাকা
সত্ত্বেও নিষ্পাপ থাকা সম্ভব।
আরো
উল্লেখ্য যে, কুরআনের
বেশকিছু আয়াতও এই বক্তব্য
সমর্থন করে যে, নবীগণের
জীবন আল্লাহর ইচ্ছায় পরিচালিত
(৫৩:৩,
২১:২৬-২৭)।
ইতিহাসে
প্রাপ্ত নবীগণের কৃত ভুল
সম্পর্কে
নানান
সূত্রে আমরা এমন সব ঘটনা জানতে
পারি, যা
থেকে মনে হয় যে কোনো কোনো নবী
বড় ধরণের ভুল করেছিলেন,
এমনকি পাপ
পর্যন্ত করেছিলেন। অথচ আমরা
বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে নবী
শনাক্ত করার উপায় চিন্তা করে
দেখেছি যে, একজন
নবীর পক্ষে গোটা জীবনে ক্ষুদ্রতম
পাপও করা সম্ভব না। অর্থাৎ
কোনো নবী তাঁর জীবদ্দশায় কোনো
একটি ক্ষুদ্র পাপও করেননি।
অর্থাৎ,
এক্ষেত্রে
যে অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করতে হবে,
তা হলো :
আমরা স্বাধীনভাবে
বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে
নবীর যে গুণবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে
সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি,
সেই
গুণবৈশিষ্ট্যগুলিকে গাইডলাইন
হিসেবে হাতে রেখে ইতিহাস বিচার
করতে অগ্রসর হবো, এবং
এর মাধ্যমে ভুল ইতিহাস থেকে
সঠিক ইতিহাস পার্থক্য করতে
পারবো।
প্রথমেই
দেখা উচিত যে, যেই
সূত্রে নবীর আপাতঃদৃষ্টিতে
কৃত ভুলের বর্ণনা এসেছে,
সেই সূত্রটি
শতভাগ অকাট্য কিনা। অর্থাৎ
সেই সূত্রটি সঠিক আছে কিনা,
এবং ঘটনাটি
আসলেই ঘটেছিলো কিনা, এবং
অবিকৃতভাবে বর্ণিত আছে কিনা,
ইত্যাদি।
যদি সূত্রে সন্দেহ থাকে,
কিংবা শতভাগ
নির্ভুল অকাট্য না হয়,
তবে সেটি
বর্জনীয়। এরপরও যদি নির্ভুল
অকাট্য সূত্রে বর্ণিত থাকে,
যেমন আল
কুরআন, সেক্ষেত্রে
দুটি ব্যাপার ঘটতে পারে :
এক.
আমি যে অনুবাদ
ও ব্যাখ্যা পড়েছি, তাতে
মূল তাৎপর্যটি সঠিকভাবে
উপস্থাপন করা হয়নি।
দুই.
আমি সরাসরি
মূল সোর্স থেকে পড়ে যে অর্থ
গ্রহণ করছি (perceive), আমার
সেই অর্থ গ্রহণে ভুল আছে। আমি
সঠিক তাৎপর্য গ্রহণ করতে
পারিনি। অর্থাৎ, আমি
এমন জিনিসকে ভুল / পাপ
বলে মনে করছি, যা
আসলে ঐ প্রেক্ষাপটে পাপ /
ভুল ছিলো
না।
ইসলামের
ইতিহাসে বিভিন্ন নবী রাসূল
সম্পর্কে এজাতীয় অনেক বর্ণনা
বহুল প্রচলিত আছে, যাতে
তাঁরা ভুল করেছেন, এমনটা
মনে হয় কিংবা এমনটা প্রচার
করা হয়। এক্ষেত্রে হয় কেউ
উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভ্রান্তি
ছড়াচ্ছে, অথবা
না জেনেই বিভ্রান্ত ধারণা
প্রচার করে বেড়াচ্ছে,
কিংবা সঠিক
তাৎপর্য গ্রহণ না করায় আসলে
যেটি ভুল নয়, সেটিকেও
ভুল বলছে, পাপ
বলছে।
[যখন তারা পিপীলিকা অধ্যূষিত উপত্যকায় পৌঁছাল, তখন এক পিপীলিকা বলল, হে পিপীলিকার দল, তোমরা তোমাদের গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদেরকে পিষ্ট করে ফেলবে। (সূরা নমল, ২৭:১৮)
সোলাইমান (আ.) এর এই ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, এমনকি পিঁপড়াও জানে যে, আল্লাহর নবী কারো উপর জুলুম করতে পারেন না। অথচ যারা দয়াল নবীজির (সা.) নামে বানোয়াট গল্প তৈরী করেছে, তারপর সেগুলিকে সহীহ হাদীস নামে চালিয়ে দিয়েছে ও বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছে, তারা আসলে নবী কি জিনিস, তা-ই জানে না। শয়তানের এজেন্টরা নবী মুহাম্মদ (সা.) কে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে, ইসলাম প্রচারক পরিচয়ের অধীনেই! আর সেই বিকৃত উপস্থাপনা দেখে অমুসলিমেরা মুহাম্মদী নূর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে যিকরে মুহাম্মদ থেকে।]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
[ব্লগে কমেন্ট পোস্ট করার পরও যদি না দেখায়, তাহলে দ্বিতীয়বার পোস্ট করার প্রয়োজন নেই। খুব সম্ভবত স্প্যাম গার্ড সেটাকে সরিয়ে নিয়েছে, আমি পাবলিশ করে দেবো।]