১লা জানুয়ারীতে আমার এক বছর যায় না। আমার এক বছর যায় ১লা রমজানে, রোজার ঈদে আর আমার জন্মদিনে। আজ তেমনি আমার একটা বছর শুরু হচ্ছে। এসময় আমি ডায়রি কিংবা ব্লগ লিখবোই।
গত রোজা থেকে এই রোজায় অনেক পার্থক্য। একটা সময় ছিলো, যখন এত দ্রুত সবকিছুর পরিবর্তন হতো না। কিন্তু তখন লিখবার প্রবল আগ্রহের কারণে পাতার পর পাতা ডায়রি লিখে যেতাম। এখন, যখন লিখবার এত্তকিছু আমার হাতে, তখন কেনো যে শিরোমানহীনের গান শুনতে শুনতে লেখার হাত অসাড় হয়ে আসে !
ভাড়া থাকা জীবন। সাড়ে ষোল বছর একই বাসায় থাকবার পর নতুন বাসায় এলাম। ভালো হোক, মন্দ হোক -- ওটাই ছিলো "আমাদের" বাসা। ওখানেই আমি আমার স্মৃতিগুলো তৈরী করেছি, আমার শৈশব-কৈশোর, আমার ছেলেবেলা -- সবতো ওখানেই ! এই নতুন বাসায় এসে এমন একটা অনুভুতি হয় যে এই বাসা "আমাদের" নয়, এটা ছেড়ে দিতে হবে একসময়। যদিও আগের বাসাটাও নিজেদের ছিলো না, কিন্তু সেখানে এমন অনুভুতি হতো না। তখন ছোট ছিলাম যে !
আমরা যখন ঐ এলাকায় যাই, তখন আশেপাশে তেমন কিছু ছিলো না। ওটাই ছিলো একমাত্র পাঁচতলা বাড়ি। সামনে অনেক বড় মাঠ ছিলো, আমরা খেলতাম। তারপর একসময় একটা দেয়াল আমাদের সেই খেলার জায়গাকে পৃথক করে দিলো। তখন আমরা অল্প একটু প্যাসেজ-এ খেলতাম প্রতিবেশীদের সাথে। কারেন্ট গেলে প্রতিবেশীরা বাটিতে করে লবণ-মরিচ দিয়ে জাম মাখিয়ে আনলে বেশ করে খেতাম। তারপর বিভিন্ন গল্প। দুর্বল স্মৃতির মানুষ আমি -- সেসব মনে রাখতে পারি নি। শুধু হালকা একটা অনুভুতিকে ধরে রাখতে পেরেছি। তার উপর কি এখন রং চড়াচ্ছি ?
"Monkey, monkey what color ?" এটা ছিলো খেলার সত্যিকারে কথা, কিন্তু অতশত বুঝি না -- "মাংকি মাংকি হট কলার" -- এই বলে প্রতিবেশী সমবয়েসীদের সাথে খেলতাম। মাংকি যেই রঙের কথা বলবে, দৌড়ে গিয়ে সেই রংটা ধরতে হবে স্কুলের গেইটে, আর না পারলে সে-ই হয়ে যাবে পরবর্তী মাংকি। স্কুলটা আবার বাসার একদম লাগোয়া ছিলো। আমরা ভাই-বোন সবাই সেখানে প্রাইমারি পর্যন্ত পড়েছিলাম। বেতন পেয়ে হোক না পেয়ে হোক, স্যার-ম্যাডামরা কী কষ্ট করেই না পড়াতো !
একটা রোজার কথা মনে পড়ে, সেসময় আমাদের স্কুলের ভিতরে, গেইটে আর ঐ খেলার প্যাসেজটার দুই দেয়ালে কার্টুন আঁকা হবে। এখন হলে নিশ্চয় ডোরেমন আঁকা হতো, কিন্তু তখন কেয়া চাকমাকে দিয়ে আঁকানো হলো মিনা-রাজুর স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য, স্মৃতিসৌধ, কিছু ফলমুল -- এইসব নিরীহ জিনিস। ছবিগুলো আঁকতে আন্টির বেশ কয়েকদিন লাগলো। ও হ্যাঁ, কেয়া চাকমা বেশ ভালো চিত্রশিল্পী, আমাদের বাসার তিনতলায় থাকতেন, কিন্তু তেমন একটা বের হতেন না। আমরা তো ছোট ছিলাম, কত কী চিন্তা করলাম ! চাকমারা কেঁচো খায়, সাপ-ব্যাঙ খায় -- এইসব যত আজগুবি কথা। দূরে গিয়ে পরস্পর কানে কানে এইসব আলাপ করতাম, আবার সবাই মিলে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকা দেখতাম।
জোর করে রোজা রেখে পরে ইচ্ছামত খেলাধুলা করা, আর তারপর বাসায় ঢুকে আনমনে পেট ভরে ভাত খেয়ে -- "ওহ হো, আমার তো খেয়ালই নাই... অবশ্য বেখেয়ালে খেলে রোজা ভাঙবে না", এই কথা বলে আবার না খেয়ে থাকা। মাঝে মাঝে এমন ব্যাপার হতো।
আমি কি খুব এলোমেলো লিখছি ?
আমাদের প্রতিবেশী ভাগ্য খুব ভালো ছিলো সবসময়। ইরান থেকে দেশে আসার পর প্রথম মনে হয় একটা বাসায় কিছুদিন থাকা হয়েছিলো, তারপর দুই-তিন বছরের মত আমরা থাকলাম আরেকটা বাসায়। বাসা বদলাবার পর আগের বাসার প্রতিবেশী খেলার সাথীরা কান্নাকাটি করে অস্থির ! পরদিনই তারা সবাই আমাদের বাসায় চলে এলো। আমার ভাবতে বেশ কষ্ট হয় যে দুর্বল স্মৃতির মানুষ হওয়ায় আমি সুন্দর স্মৃতিকে বন্দী করতে পারি নি। শুধু সেই অনুভুতিগুলোর এক টুকরা করে আমার মাঝে রয়ে গিয়েছে। সেই অনুভুতিকে প্রাণ দিতে গিয়ে ভুল করছি নাতো ?
তবে আমার "বড় হয়ে ওঠা" ঐ সাড়ে-ষোল-বছরের বাসাটিতেই। ইথিকা আপু, শিফা-পপি, সাইফ-শুভ, খালেদ-শাহ আলম আর নিলয় -- স্মৃতিতে এটুকুই আছে প্রতিবেশী খেলার সাথীর নাম হিসেবে। এখনতো আমি নিজেকে অনেক গুটিয়ে রাখি বা এনেছি, কিন্তু আমার স্বভাবসুলভ চপলতা আর ছেলেমানুষি সেমসয় গোপন করি নি। এখন তো গোপন করতে শিখে গিয়েছি। যখন তা জানতাম না, তখন ২৪ ঘন্টাকে টেনে লম্বা করে ৪৮ ঘন্টা বানিয়ে তার ভিতর খেলতাম। কাঁঠাল-গাছ খেলা, দাদুর নামাজ পড়া খেলা (এটা মেবি আমরা ইন্ট্রোডিউস করেছিলাম, ইরানের আমদানি), আর কানামাছি কিংবা ছোঁয়াছুঁয়ি অথবা কুমির-কুমির -- এগুলো তো আছেই ! সর্বশেষ ক্লাস সিক্স কি সেভেনে থাকতে নানাবাড়ি এই খেলা খেলেছিলাম বলে মনে পড়ে। এখনকার ক্লাস সেভেনের ছেলেপেলেদের সাথে মিলাতে গেলে হাসবেন, কিন্তু সেটা প্রায় সাত-আট বছর আগের কথা। যুগ বদলানোর গতিতে ত্বরণ আছে, সময়ের সাথে বেগ বৃদ্ধি হয়।
কী সব আবোল-তাবোল বলছি।
সেদিন এক বন্ধুর সাথে হাজার লাইনের চ্যাটিঙে এসব কথার কিছু কিছু বলেছি। তাকে বলেছি -- আমি তোমার মত অত সুন্দর স্মৃতি তৈরী করতে না পারলেও অল্প কিছু তৈরী করেছি।
তারপর স্মৃতি হাতড়ে একটু একটু বের করে দেখিয়েছি। আরো অনেক আছে, আমার স্মৃতিতে নেই শুধু। আমার বাবা-মা আর ভাই-বোনেদের স্মৃতিতে আছে। তারা যদি সেগুলিকে লিখে না রাখে, তবে হারিয়ে যাবে নিশ্চিত।
একটু বড় হবার পর, যখন থেকে ডায়রি লেখা শুরু করেছি -- কোনো রোজাতেই বাদ যায় নি। তারপর একসময় ব্লগিঙে নেশা ধরলো। এখন সবই গুটিয়ে গিয়েছে। জড়তা চলে এসেছে। সবই হয়, তবে খুব অল্প অল্প। আগে ডায়রি নিয়ে চিন্তা করতাম -- এটা শেষ হলে কোনটায় লিখবো, এটা তো শেষ হলো বলে; আর এখন বছর-বছর ডায়রি পেলেও পুরনো সালের ডায়রিতেই লেখা শেষ হয় না। নতুনগুলো জমতে থাকে।
আমি গত কয়েকদিন যাবৎ চিন্তার স্রোতে ভেসে যাচ্ছি। নিজের চিন্তার কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। কোত্থেকে শত শত মাইল নিউরনের পথ পাড়ি দিয়ে স্মৃতিরা এসে জড়ো হচ্ছে ! পুরনো সব ভাবনা বন্যার জলের মত করে এসে আমার শক্ত ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি এত পরিবর্তনকে ধরতে পারছি না, সেইসাথে পুরনো সব ভাবনা না চাইতেই কেনো এসে আঁকড়ে ধরছে ?
আমার সম্পর্কে মানুষ কী ভাবে, তা তাদের ভাষ্য থেকে জানার সুযোগ খুব কম হয়েছে। তবে আমি মানুষকে জানার চেষ্টা করেছি, আর এ-ও মাঝে মাঝে চিন্তা করেছি, আমার সম্পর্কে তারা কী ভাবে ! যাহোক, সেই "খুব অল্প" সুযোগে একবার অদ্ভুত কিছু কথা জেনেছিলাম।
এই বিশাল দুনিয়ায় রঙ খুঁজে বেড়ানো মানুষটি লিখেছিলো -- "আমার জীবন চারণ বেশ বড় ব্যাপ্তিতেই ঘটেছে। অনেক রঙ দেখেছি আমি। আমি খুব বেশী সাদাকালো তো, তাই রঙিন বস্তুগুলোকে আপন করতে পারি নি। হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। নিজেকে অসহায় ভেবেছি। তবে তোমাকে কিভাবে যেন ধরেছি।"
গত রোজা থেকে এই রোজায় অনেক পার্থক্য। একটা সময় ছিলো, যখন এত দ্রুত সবকিছুর পরিবর্তন হতো না। কিন্তু তখন লিখবার প্রবল আগ্রহের কারণে পাতার পর পাতা ডায়রি লিখে যেতাম। এখন, যখন লিখবার এত্তকিছু আমার হাতে, তখন কেনো যে শিরোমানহীনের গান শুনতে শুনতে লেখার হাত অসাড় হয়ে আসে !
ভাড়া থাকা জীবন। সাড়ে ষোল বছর একই বাসায় থাকবার পর নতুন বাসায় এলাম। ভালো হোক, মন্দ হোক -- ওটাই ছিলো "আমাদের" বাসা। ওখানেই আমি আমার স্মৃতিগুলো তৈরী করেছি, আমার শৈশব-কৈশোর, আমার ছেলেবেলা -- সবতো ওখানেই ! এই নতুন বাসায় এসে এমন একটা অনুভুতি হয় যে এই বাসা "আমাদের" নয়, এটা ছেড়ে দিতে হবে একসময়। যদিও আগের বাসাটাও নিজেদের ছিলো না, কিন্তু সেখানে এমন অনুভুতি হতো না। তখন ছোট ছিলাম যে !
আমরা যখন ঐ এলাকায় যাই, তখন আশেপাশে তেমন কিছু ছিলো না। ওটাই ছিলো একমাত্র পাঁচতলা বাড়ি। সামনে অনেক বড় মাঠ ছিলো, আমরা খেলতাম। তারপর একসময় একটা দেয়াল আমাদের সেই খেলার জায়গাকে পৃথক করে দিলো। তখন আমরা অল্প একটু প্যাসেজ-এ খেলতাম প্রতিবেশীদের সাথে। কারেন্ট গেলে প্রতিবেশীরা বাটিতে করে লবণ-মরিচ দিয়ে জাম মাখিয়ে আনলে বেশ করে খেতাম। তারপর বিভিন্ন গল্প। দুর্বল স্মৃতির মানুষ আমি -- সেসব মনে রাখতে পারি নি। শুধু হালকা একটা অনুভুতিকে ধরে রাখতে পেরেছি। তার উপর কি এখন রং চড়াচ্ছি ?
"Monkey, monkey what color ?" এটা ছিলো খেলার সত্যিকারে কথা, কিন্তু অতশত বুঝি না -- "মাংকি মাংকি হট কলার" -- এই বলে প্রতিবেশী সমবয়েসীদের সাথে খেলতাম। মাংকি যেই রঙের কথা বলবে, দৌড়ে গিয়ে সেই রংটা ধরতে হবে স্কুলের গেইটে, আর না পারলে সে-ই হয়ে যাবে পরবর্তী মাংকি। স্কুলটা আবার বাসার একদম লাগোয়া ছিলো। আমরা ভাই-বোন সবাই সেখানে প্রাইমারি পর্যন্ত পড়েছিলাম। বেতন পেয়ে হোক না পেয়ে হোক, স্যার-ম্যাডামরা কী কষ্ট করেই না পড়াতো !
একটা রোজার কথা মনে পড়ে, সেসময় আমাদের স্কুলের ভিতরে, গেইটে আর ঐ খেলার প্যাসেজটার দুই দেয়ালে কার্টুন আঁকা হবে। এখন হলে নিশ্চয় ডোরেমন আঁকা হতো, কিন্তু তখন কেয়া চাকমাকে দিয়ে আঁকানো হলো মিনা-রাজুর স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য, স্মৃতিসৌধ, কিছু ফলমুল -- এইসব নিরীহ জিনিস। ছবিগুলো আঁকতে আন্টির বেশ কয়েকদিন লাগলো। ও হ্যাঁ, কেয়া চাকমা বেশ ভালো চিত্রশিল্পী, আমাদের বাসার তিনতলায় থাকতেন, কিন্তু তেমন একটা বের হতেন না। আমরা তো ছোট ছিলাম, কত কী চিন্তা করলাম ! চাকমারা কেঁচো খায়, সাপ-ব্যাঙ খায় -- এইসব যত আজগুবি কথা। দূরে গিয়ে পরস্পর কানে কানে এইসব আলাপ করতাম, আবার সবাই মিলে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকা দেখতাম।
জোর করে রোজা রেখে পরে ইচ্ছামত খেলাধুলা করা, আর তারপর বাসায় ঢুকে আনমনে পেট ভরে ভাত খেয়ে -- "ওহ হো, আমার তো খেয়ালই নাই... অবশ্য বেখেয়ালে খেলে রোজা ভাঙবে না", এই কথা বলে আবার না খেয়ে থাকা। মাঝে মাঝে এমন ব্যাপার হতো।
আমি কি খুব এলোমেলো লিখছি ?
আমাদের প্রতিবেশী ভাগ্য খুব ভালো ছিলো সবসময়। ইরান থেকে দেশে আসার পর প্রথম মনে হয় একটা বাসায় কিছুদিন থাকা হয়েছিলো, তারপর দুই-তিন বছরের মত আমরা থাকলাম আরেকটা বাসায়। বাসা বদলাবার পর আগের বাসার প্রতিবেশী খেলার সাথীরা কান্নাকাটি করে অস্থির ! পরদিনই তারা সবাই আমাদের বাসায় চলে এলো। আমার ভাবতে বেশ কষ্ট হয় যে দুর্বল স্মৃতির মানুষ হওয়ায় আমি সুন্দর স্মৃতিকে বন্দী করতে পারি নি। শুধু সেই অনুভুতিগুলোর এক টুকরা করে আমার মাঝে রয়ে গিয়েছে। সেই অনুভুতিকে প্রাণ দিতে গিয়ে ভুল করছি নাতো ?
তবে আমার "বড় হয়ে ওঠা" ঐ সাড়ে-ষোল-বছরের বাসাটিতেই। ইথিকা আপু, শিফা-পপি, সাইফ-শুভ, খালেদ-শাহ আলম আর নিলয় -- স্মৃতিতে এটুকুই আছে প্রতিবেশী খেলার সাথীর নাম হিসেবে। এখনতো আমি নিজেকে অনেক গুটিয়ে রাখি বা এনেছি, কিন্তু আমার স্বভাবসুলভ চপলতা আর ছেলেমানুষি সেমসয় গোপন করি নি। এখন তো গোপন করতে শিখে গিয়েছি। যখন তা জানতাম না, তখন ২৪ ঘন্টাকে টেনে লম্বা করে ৪৮ ঘন্টা বানিয়ে তার ভিতর খেলতাম। কাঁঠাল-গাছ খেলা, দাদুর নামাজ পড়া খেলা (এটা মেবি আমরা ইন্ট্রোডিউস করেছিলাম, ইরানের আমদানি), আর কানামাছি কিংবা ছোঁয়াছুঁয়ি অথবা কুমির-কুমির -- এগুলো তো আছেই ! সর্বশেষ ক্লাস সিক্স কি সেভেনে থাকতে নানাবাড়ি এই খেলা খেলেছিলাম বলে মনে পড়ে। এখনকার ক্লাস সেভেনের ছেলেপেলেদের সাথে মিলাতে গেলে হাসবেন, কিন্তু সেটা প্রায় সাত-আট বছর আগের কথা। যুগ বদলানোর গতিতে ত্বরণ আছে, সময়ের সাথে বেগ বৃদ্ধি হয়।
কী সব আবোল-তাবোল বলছি।
সেদিন এক বন্ধুর সাথে হাজার লাইনের চ্যাটিঙে এসব কথার কিছু কিছু বলেছি। তাকে বলেছি -- আমি তোমার মত অত সুন্দর স্মৃতি তৈরী করতে না পারলেও অল্প কিছু তৈরী করেছি।
তারপর স্মৃতি হাতড়ে একটু একটু বের করে দেখিয়েছি। আরো অনেক আছে, আমার স্মৃতিতে নেই শুধু। আমার বাবা-মা আর ভাই-বোনেদের স্মৃতিতে আছে। তারা যদি সেগুলিকে লিখে না রাখে, তবে হারিয়ে যাবে নিশ্চিত।
একটু বড় হবার পর, যখন থেকে ডায়রি লেখা শুরু করেছি -- কোনো রোজাতেই বাদ যায় নি। তারপর একসময় ব্লগিঙে নেশা ধরলো। এখন সবই গুটিয়ে গিয়েছে। জড়তা চলে এসেছে। সবই হয়, তবে খুব অল্প অল্প। আগে ডায়রি নিয়ে চিন্তা করতাম -- এটা শেষ হলে কোনটায় লিখবো, এটা তো শেষ হলো বলে; আর এখন বছর-বছর ডায়রি পেলেও পুরনো সালের ডায়রিতেই লেখা শেষ হয় না। নতুনগুলো জমতে থাকে।
আমি গত কয়েকদিন যাবৎ চিন্তার স্রোতে ভেসে যাচ্ছি। নিজের চিন্তার কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। কোত্থেকে শত শত মাইল নিউরনের পথ পাড়ি দিয়ে স্মৃতিরা এসে জড়ো হচ্ছে ! পুরনো সব ভাবনা বন্যার জলের মত করে এসে আমার শক্ত ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি এত পরিবর্তনকে ধরতে পারছি না, সেইসাথে পুরনো সব ভাবনা না চাইতেই কেনো এসে আঁকড়ে ধরছে ?
আমার সম্পর্কে মানুষ কী ভাবে, তা তাদের ভাষ্য থেকে জানার সুযোগ খুব কম হয়েছে। তবে আমি মানুষকে জানার চেষ্টা করেছি, আর এ-ও মাঝে মাঝে চিন্তা করেছি, আমার সম্পর্কে তারা কী ভাবে ! যাহোক, সেই "খুব অল্প" সুযোগে একবার অদ্ভুত কিছু কথা জেনেছিলাম।
এই বিশাল দুনিয়ায় রঙ খুঁজে বেড়ানো মানুষটি লিখেছিলো -- "আমার জীবন চারণ বেশ বড় ব্যাপ্তিতেই ঘটেছে। অনেক রঙ দেখেছি আমি। আমি খুব বেশী সাদাকালো তো, তাই রঙিন বস্তুগুলোকে আপন করতে পারি নি। হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। নিজেকে অসহায় ভেবেছি। তবে তোমাকে কিভাবে যেন ধরেছি।"
হয়তো সে সাদাকালো ছিলো। কিন্তু সূর্যকিরণে তার চোখ যখন রঙিন হয়ে ওঠে, আর তা দেখে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তখন কি তাকে সাদাকালো মনে হয় ? কই, নাতো !
বরং আমিই সাদাকালো ছিলাম, আর তা-ই রয়ে গিয়েছি। কখনো কখনো কেউ আমাকে রঙিন ভেবে ভুল করেছে, কাছে এসেছে হয়তো, আবার হয়তো দূরে সরে গিয়েছে। যে মানুষ সাদাকালো, তাকে রঙ দিয়ে জড়ালেও সে বদলায় না। আমি কোনো রঙকে মুছে ফেলেছি সাদা দিয়ে, আর কোনোটাকে বা কালো দিয়ে। তারপর আমি আবার আগের মত রয়ে গিয়েছি।
জীবনে মাঝে মাঝে যখন অসংখ্য রঙের খেলা দেখেছি, তখন নিজের গায়ে একটু রং মাখতে গিয়েছি। কিংবা সবার অগোচরে কিছুটা চুরি করে এনে সুন্দর কাঁচের কৌটায় ভরে রাখতে চেয়েছি। তারপর দেখেছি, ছোট্ট শিশুর আঁজলা ভরে পানি আনার মত আমার হাত গলে রঙগুলি পড়ে গিয়েছে। আমি সেই আগেরটিই রয়ে গিয়েছি -- ভাগ্যের শিশু।
সেই সময়কে পার করে ফেলেছি। এখন, যখন নিজেকে রঙিন করবার অক্ষমতায় চুপচাপ স্মৃতিচারণে মশগুল হই, তখন হঠাৎ হঠাৎ আবেগের তীব্রতায় কিছু একটা পাগলামি করে ফেলতে ইচ্ছে করে ! কিন্তু আমি আমার স্মৃতির ক্ষমতা জানি। তারা বড়জোর চোখকে জ্বালা করাতে পারে, কিংবা কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে বাধ্য করতে পারে, কিন্তু এর বেশি কিছু পারে না। তাই আমি স্মৃতিচারণে আমার সত্ত্বাকে উন্মুক্ত করে দিই। ছোট চৌবাচ্চা, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় অথৈ সমুদ্র ! আমি সেই অল্প পানির প্রতিটি পরমানু পর্যন্ত আস্বাদন করি। খেলা শেষ হলে আবার খেলি। এই খেলা যখন স্বেচ্ছায় হয় না, যখন আর কেউ আমাকে জোর করে করায়, তখন সত্যিই নিজেকে ভাগ্যের শিশু বলে মনে হয়। মনে হয় আর কেউ আমাকে নিয়ে খেলছে, আমি তার ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে পারছি না।
এই সমস্ত ব্যাপার ঘটতে পারে কম্পিউটারে একটা প্রোগ্রাম লিখতে লিখতে, বন্ধুর সাথে নেটে কথা বলতে বলতে কিংবা পরবর্তী ক্লাসের জন্য স্লাইড তৈরী করতে করতে।
অনেক গান শুনলাম। অল্প ক-টাই বারবার শুনলাম। অনেক কথা লিখলাম। অনেক কথাই বললাম। এসব কথা আর লেখা হবে না। ডায়রিতে হয়তো হয়েছে লেখা, কিন্তু সেটা ডায়রি-ই। ডায়রি আর ব্লগ তো এক নয়।
মাঝে মাঝে ব্লগে লেখা থামাতে ইচ্ছা করে না। যেমন ইচ্ছা করে না বহুদিন পর পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হলে বাড়ি ফিরতে ! কিন্তু উৎসবের একটা সমাপ্তি আছে। নইলে তাকে কেউ উৎসব বলতো না। স্বর্গসুখ পৃথিবীর জন্য নয়। "অনন্তের" স্পর্শ মৃত্যুর আগে হলে তা ক্লান্ত করে ফেলে মানুষকে। আমরা সসীম তো, তাই।
স্বর্গের প্রেমে নাই বিরহ অনল / সুন্দর আঁখি আছে / নাই আঁখি জল।।
গানটা নজরুলের। মর্ত্যের নজরুল তো একথা লিখবেই। কে জানে স্বর্গের নজরুল কী লিখছে !
নূরে আলম
জুলাই ২১, ২০১২।
lekha valo hoise....jothesto valo....tobe arektu gochhano hole valo hoto...
উত্তরমুছুনধন্যবাদ!
মুছুনস্মৃতিচারণ...
উত্তরমুছুন