সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রথম আলো, বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর তথ্য-প্রমাণের দৌড়

ফেইসবুকে বন্যার পানির মত ভেসে যাওয়া শত শত পোস্টের মাঝে একটা পোস্টে চোখ আটকে গেলো। ফেইসবুকে নয়া দিগন্তের পেইজ একটা লেখা শেয়ার দিয়েছে, সেটা আবার শেয়ার করেছে যীনাত। আমি নয়া দিগন্ত পত্রিকায় খুঁজে নিউজটা পেলাম না। যাহোক, পোস্টের শিরোনাম : "চট্টগ্রামের ফয়'স লেকে মাদক বিরোধী কনসার্টের নামে অশ্লীলতা ছড়ানো অভিযোগ "
পোস্টে কোনো পত্রিকার লিঙ্ক দেয়া হয় নি, এবং কোনো তারিখ উল্লেখ ছাড়াই একটা ছবির সাথে যা যা লেখা হয়েছে, তার মূল কথা এই : "প্রথম আলো, কনকর্ড, বাংলালিঙ্ক এর উদ্যোগে চট্টগ্রাম ফয়'স লেকে আয়োজিত মাদক-বিরোধী কনসার্টে অশ্লীলতার চর্চা হয়েছে -- তরুণ-তরুণীরা একত্রে পানিতে নেমে উচ্ছৃঙ্খলতায় মেতে ওঠে।"

আমি সাধারণত এজাতীয় জিনিস ইগনোর করে যাই, তবে যে জিনিসটা আমাকে এই ব্লগ লিখতে এবং একঘন্টা গুগল সার্চে ব্যয় করতে বাধ্য করলো তা এই (স্ক্রিনশট) :




বিবর্ন আজাদ (লিমন) যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বলেছে, তা এই :
১. "এটা সব সময়ই হয়। এমন না শুধু ঐ দিনই হয়েছে।" [ আমি যে সেন্স ক্যাচ করলাম তা হলো -- এটাকে এত সিরিয়াসলি নেবার কিছু নেই। এটা তো একদিনের কোনো ঘটনা না। এটা একটা রেগুলার হ্যাপেনিং। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ]
২. "আর উপরের ছবিটা যে ঐ দিনেরই তারই বা প্রমাণ কই ? আমার তো মনে হচ্ছে এটা নন্দন অথবা ফ্যান্টাসির ছবি!!" [ লিমন জানতে চেয়েছে, ছবিটা অথেনটিক কিনা। অর্থাৎ, বিবিসির মত করে এক ছবি আরেক নিউজে লাগিয়ে দেয়া কিনা। আর লিমন যেহেতু বলেছে যে "ঐ দিনেরই", আমি ধরে নিচ্ছি যে "প্রথম আলো মাদক-বিরোধী কনসার্ট আয়োজন করেছে", এই ঘটনাটিকে সে সত্য বলে মানছে। অর্থাৎ, ঘটনাটি প্রথম আলোর সাংবাদিক দীপাঞ্জন রায় চৌধুরীর বিএনপিকে নিয়ে তৈরী বানোয়াট নিউজের মত কোনো ব্যাপার নয়। ]
"নন্দন অথবা ফ্যান্টাসির ছবি!!" -- এই কথা থেকে আমি বুঝে নিলাম যে শুধুমাত্র পানি, (কিংবা পানির রং) আর কিছু পাথর (ছবিতে একদম উপরে) দেখেই লিমন নন্দন, ফ্যান্টাসি কিংডম আর ফয়'স লেক, ইত্যাদি আলাদা করতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে, আমার এসব সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তাই এখনই কিছু বলতে পারছি না। ]
৩. "এই সব নোংরামির প্রতিবাদ করতে হলে শুধুমাত্র প্রথম আলোর ঐ event বাদ দিয়ে পুরো system এর প্রতিবাদ করা উচিৎ।" আমি নয়া দিগন্তের ওয়েবসাইটে এই নিউজটি পাই নি। আর যদি তারা নিউজ করেও থাকে, শুধু নয়া দিগন্ত কেনো, অন্য যেকোন পত্রিকাই হোক, তারা যখন নিউজ করে, তখন তার একটা বিশেষ ধরণ থাকে। "প্রতিবেদন", "সম্পাদকীয়", "আলোচনা", "সমালোচনা", "বিশ্লেষণ" -- এগুলো যে ভিন্ন ভিন্ন জিনিস, এবং এগুলোর যে নিজস্ব স্টাইল আছে, তা পত্রিকা পড়া মানুষেরা কিংবা পত্রিকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা খুব ভালোই বোঝেন আশা করি। লেখাটির ধরণ প্রতিবেদনের মত। রিপোর্টে "প্রতিবাদের স্বর" উচ্চারিত হয় না। সেটা হয়ে থাকে সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়তে। আর এখানে "পুরো সিস্টেম" আসলো কেনো ? event টা আয়োজন করেছে প্রথম আলো এবং আরো কিছু প্রতিষ্ঠান সুতরাং তাদের নাম উল্লেখ করতেই হবে রিপোর্টে। লিমন চাইছে না যে এসং নোংরামির আয়োজক হিসেবে প্রথম আলোর নাম প্রচারিত হোক। আর সে যে এগুলোর বিরোধীতা করছে, কিংবা মনে করছে যে এগুলো বন্ধ করা উচিত, তা-ও কিন্তু নয়। সে বলেছে -- প্রতিবাদ "করতে হলে" প্রথম আলোর ঐ event বাদ দিয়ে "পুরো sysetm এর প্রতিবাদ করা উচিত"। সে এখানে অসঙ্গতি (তার কাছে) তুলে ধরেছে, পক্ষে-বিপক্ষে কিছু বলে নি। সতর্ক কমেন্ট বটে ! ]
৪. "তবে যেেহতু এটা নয়া দিগন্ত সো ঠিকই আছে....." অর্থাৎ, যেহেতু নয়া দিগন্ত, সেহেতু তাদের পক্ষে এমন "অসঙ্গতিপূর্ণ" কাজ করাটাই স্বাভাবিক (অর্থাৎ পুরো সিস্টেমের প্রতিবাদ না করে প্রথম আলোর আয়োজিত ইভেন্টের প্রতিবাদ করা (যদিও এখানে কোনো প্রতিবাদ করা হয় নি))। অর্থাৎ, লিমনের মতে এমন "অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ" নয়া দিগন্ত করে থাকে, এবং তারা প্রথম আলোর বিরুদ্ধে লেখে / লেখার চেষ্টা করে। ]



অনেক কথা হলো। আমি এক ঘন্টা গুগল সার্চ করে যা আবিষ্কার করলাম, তা হলো, ১৭ই জুন ২০১১ তারিখে চট্টগ্রাম ফয়'স লেকে মাদক-বিরোধী কনসার্টের আয়োজন করা হয়, যার আয়োজকদের মাঝে প্রথম আলোও ছিলো। পানিতে নেমে বৃষ্টির মাঝেও তরুণ-তরুণীরা নাচানাচি করেছে। প্রথম আলোর সেসময়ের রিপোর্ট  থেকে : "চলছিলো ধুন্ধুমার নাচ ও গান।... এত উল্লাস, উন্মাদনায়ও কারও যেনো কোনো ক্লান্তি নেই।"

বিষয়টা আমি ক্রস চেকিং এর মাধ্যমে নিশ্চিত হলাম। প্রথম আলো ব্লগ, সামহোয়্যাইন ব্লগ, প্রথম আলো পত্রিকা, এবং সোনারবাংলাদেশ ব্লগের ব্লগার আজব মানুষ এর এই পোস্টের কমেন্ট থেকে। স্ক্রিনশটগুলো পরপর দিচ্ছি, কষ্ট করে দেখুন।


...................................................................................................................


..................................................................................................


..........................................................................................

................................................................................................

...........................................................................................


অতঃপর....
গত ৭ই জুলাই ২০১২ অনুরূপ কনসার্টের আয়োজন করা হলো। এটা নিশ্চিত হয়েছি প্রথম আলো পত্রিকা, বিসিজেএ নিউজ, এবং সোনার বাংলাদেশ ব্লগে আজব মানুষের লেখা পোস্টের ছবির লোগো এবং প্রথম আলোতে প্রকাশিত লেখায় ব্যবহৃত একই লোগো চেক করার মাধ্যমে।
স্ক্রিনশটগুলো দেখুন :

......................................................................................

......................................................................................

........................................................................................

আমার আর বেশি কিছু বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না।
যারা ফেসবুকে অনেক পোস্ট শেয়ার করেন, তাদের উদ্দেশ্যে একটা কথা বলি -- লিমনের মত করে যদি কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করে, তখন আপনার এমনই ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় হয়ে যেতে পারে, যদি আপনি ডেসপারেট হন বিষয়টার সত্যতা প্রমাণ করতে। আরেকটা কথা, কিছু শেয়ার করার আগে জানার চেষ্টা করবেন বিষয়টা অথেনটিক কিনা। ফেসবুকে মানুষের শেয়ারিং প্রবণতাকে ব্যবহার করে অনেক মানুষ মিথ্যা / অবাস্তব জিনিস / নিউজ ছড়িয়ে থাকে। সহজ ভাবনায় একটা পোস্ট শেয়ার দিয়ে আপনিও এদের শিকার হতে পারেন !

আর -- দুঃখ লাগে, যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ব্রিলিয়ান্ট ছেলে-মেয়েরা সত্যকে, বিবেককে সচেতনভাবে পাশ কাটিয়ে কিভাবে নিজের চোখে ঠুলি বেঁধে নেয়, আর শিখিয়ে দেয়া বুলি শিখিয়ে দেয়া স্টাইলে আউড়াতে থাকে !

মানুষকে তো অনেক ভাগে ভাগ করা যায়। আল্লাহ মানুষকে ভাগ করেছেন দুই ভাগে -- বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসী। সত্যের পথের মানুষ আর অসত্যের পথের মানুষ। It is high time I've separated some of them around me.




নূরে আলম
জুলাই ১১, ২০১২।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা