"না, এটা আগে পিটিয়ে শক্ত করতে হবে। তাহলে সুবিধা হবে। এখনও অনেক নরম।"
"আরে, এটার সাথে তো পেপার লেগে গেসে।"
"আমি বেশিরভাগ পিষছি, আপনি বাকিটুকু করেন।"
"দেখসেন, চালার পর কতটুকু হয়ে গেসে ! হরলিকস এর মাত্র দুই বোয়েমেই ভরে গেসে ! অথচ প্রথমে কত বেশি দেখাচ্ছিলো !"
তারপর আমাদের বসে মাটির খেলনা বানানো। মাটির পাখি, তার নাম দেয়া হলো স্কুলের বইয়ের সেই পাখিটার নামে-- রংরাং পাখি। হাতি-- তার পিঠের মাঝে পয়সা রাখার ব্যবস্থা করা হলো ! মাটির ঘর, তার মাঝেও পয়সা রাখা যাবে। মাটির ঘন্টা-- কিন্তু দোকানের সেই মাটির ঘন্টার মত শব্দ তো আর হলো না ! মাটির নৌকা, ফুল, হাঁস, মসজিদ আর মন্দির ! আর মাটির নীল রঙের ডলফিনটা। মাটির ঘোড়া, যার লেজটা বানাবার সময় হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যাবার অবস্থা-- কুকুরের মত হয়ে যাচ্ছিলো বারবার ! তারপর মাটির শেষ গুঁড়োটুকু দিয়ে শাড়ি-পরা, কলসি কাঁখের দুই সেন্টিমিটার লম্বা ছিপছিপে মহিলাটা।
এরপর আবার দিন গড়াতে থাকে। মাটি নিয়ে খেলার দিন শেষ হয়ে যায়। মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে বড় হয়ে যায়। সবাই তো আর বড় "হয়" না-- অনেকে বড় "হয়ে যায়"। সে যাই হোক, বড় তো হওয়া হয় !
ব্যস্ত পার করতে থাকা দিনগুলোয় আর চিন্তা করার অবসর মেলে না। শুধু কাজ আর কাজ। মাটি নিয়ে খেলা করা দিনগুলো সেপিয়া মোডের ছবি হয়ে যায়। "ইচ্ছে করে করা" ব্যস্ত স্মৃতিচারণগুলোর চাপে তারা আর ভিড়তেই পারে না ! তারা নিউরনের গহীনে লুকিয়ে পড়ে।
কখনো কখনো হঠাৎ করেই স্টিমুলেশান নেবার স্মৃতিগুলো চারণ করা শেষ হয়ে আসে। বারবার ডেকে আনায় তারা আর পুরনো থাকে না, তাজা হয়ে ওঠে। কিন্তু সে ধুলো তো আর মোছে না ! তখন তারা ছিবড়ে হয়ে ওঠে। লজ্জিত স্মৃতিরা আপনা থেকেই লুকোয়।
আমি সে স্মৃতিদের গতিপথ আর লক্ষ্য করি না। যেখানে খুশি যাক।
স্মৃতিগুলো চলে যাবার পর আমি গান শুনতে বসি-- আরো কিছুক্ষণ কি রবে বন্ধু, আরো কিছু কথা কি হবে...
কিংবা -- আমার এ মন কেনো শুধু আকুলায়, বরষণ যেনো কোথা হয়েছে...
অথবা -- বেলা শেষে ফিরে এসে পাই নি তোমায়, কৃষ্ণচূড়ার রঙে এঁকেছি তোমায় / মুছো না তুমি তারে দুঃখের ছোঁয়ায়, সাজিয়ে রেখো মন মণিকোঠায়...
তারপর -- বন্ধু তোমায় এ গান শোনাবো বিকেল বেলায়, আর একবার যদি তোমাদের দলে নাও খেলায়.....
গান শেষে আবার স্মৃতিচারণ করতে বসলে দেখি, তারা কোথায় যেনো লুকিয়েছে। আমি আর খুঁজে পাই না, খোঁজার চেষ্টাও করি না। তখন শুধু সেই স্মৃতিরা থাকে, স্টিমুলেশান নেয়া স্মৃতিগুলোর আড়ালে যারা চাপা পড়েছিলো।
আমি আবার মাটি এনে বারান্দার মেঝেতে ফেলি। পুরনো পত্রিকার উপর মাটির ঢেলাগুলো ছড়িয়ে দিই। অফুরন্ত সময় নিয়ে তাদের শুকোতে দিই। এরপর শূন্য ঘরে একা বসে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে শক্ত ঢেলাগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করি। তারপর সারা দুপুর তাদের পিষে মিহিন দানা করে বিকেলে চালতে বসি।
আমি এখন বড় হয়েছি না ! এখন কি আর ঐ অল্প গুঁড়োতে হবে ? তাই আমি বড় বড় পাত্রে এত এত মাটির গুঁড়ো তুলে রাখি। এখন আমার খেলার জিনিসে কেউ ভাগ বসাবে না। সারা ঘরের যেখানে খুশি আমি বসে খেলব। ইচ্ছেমতো রাত জাগব। সারারাত মাটি ছেনে ঠান্ডা লাগালেও কেউ কিচ্ছু বলবে না। কিন্তু রাত হয়ে গিয়েছে যে ! পরদিন কত কী বানাবো, মনের মতো করে, নিখুঁত থেকে নিখুঁততর করে, সেই স্বপ্নে আমি রাত পার করি।
সকাল হয়। এই সকালে নিত্যদিনকার কাজগুলি থাকে না। আমি মসৃণ করা বড় এক কাঠের তক্তায় মাটির গুঁড়ো ছড়িয়ে বসি। এখন আমার সবই আছে-- বাড়ির নকশা, গাড়ির নকশা, মানুষগুলোর নকশা, আরো সব। এখন পানি দিলেই সব হয়...। কিন্তু হায় ! আমার পানি যে শুকিয়ে গিয়েছে ! অনেক কষ্টে জগের তলায় যে অল্প একটু পানি পাই, তাতে আমার কিছুই হয় না। হয়তো হতো, ঢের হতো, কিন্তু আমি বড় হয়েছি না !
সব পড়ে থাকে। আমার আর খেলা শেষ করা হয় না।
নূরে আলম,
ডিসেম্বর ১২, ২০১১।
সব পড়ে থাকে। আমার আর খেলা শেষ করা হয় না।
নূরে আলম,
ডিসেম্বর ১২, ২০১১।
হ... কথা ঠিক। এত আবেগ দিয়া লেখা একটু একটু কেমন কেমন জানি লাগল........ যার মুখে যা মানায় না আর কি...:|
উত্তরমুছুনভরা জগ পেতে হল বিয়ে করে ফেলুন। :p
উত্তরমুছুনলেখা ভালই হয়েছে। মোটামুটি ভাল।
এই স্মৃতিগুলোকে প্যাকেটে করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম শোবার ঘরের কোন এক কোণে। আমি আর চাইনা ওরা ফিরে আসুক। এই গানগুলো, সেই সময়, সেই গন্ধগুলো... ফেলে আসা কিছু অনর্থক স্মৃতিকে বিস্মৃত করে প্রশান্ত থাকা গেলে আমি সেটাকেই বেছে নিতে চাই
উত্তরমুছুন