আবার রমজানের গল্প করতে বসলাম। ডায়েরীতে তো অনেকবারই হল, এবার ডায়েরীর পাতা থেকে লাফ দিয়ে চলে এলাম ব্লগের পাতায়।
কিছুদিন আগে রাস্তার 'পরের ভ্যান থেকে শশা কিনছিলাম। এক প্রতিবেশী (ভূতপূর্ব!) আন্টির সাথে দেখা হল। আন্টি তার ছেলে জিসানকে নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন, দেখা হওয়ায় জিজ্ঞাসা করলেন- "এখনও কি তুমি আর্ট করো?"
মানুষ তো ছোট থেকে বড় হয়, বড় থেকে বুড়ো হয়। সময়ের দাগ পড়তে থাকে। কিন্তু কারো সাথে শেষ দেখাটা যদি হয় অনেক বছর আগে, মানুষ তখন সময়ের দাগের কথা ভুলে যায়, হঠাৎ দেখা হলে বলে- "তুমি এত বড় হয়ে গেসো?" কিংবা- "এখনও কি তুমি আর্ট করো?"
আমি আগে ছবি আঁকতাম।
গ্রামের দৃশ্য, কার্টুন ক্যারেক্টার, এইসব। ছবি এঁকে কার্ডে লাগিয়ে মুখোশ বানাতাম। মুখোশ বানিয়ে আমি, সেজাপু আর যীনাত একবার ঘর ভরে ফেলেছিলাম। আমার বানানো ভুতের মুখোশ যীনাত একবার স্কুলেও নিয়ে গিয়েছিল.....
এমনি এক ছবি আঁকা রমজানের কথা মনে পড়ছে। সেহরি খাওয়া শেষে আমি আর সেজাপু ড্রয়িঙ রুমের কার্পেটের 'পর বসে ছবি আঁকতাম। বোর্ডের বাংলা বই-এ যত ছবি, তার সব। আমি কী আঁকতাম- অতটা খেয়াল নেই, কিন্তু সেজাপুর আঁকা একটা ছবির কথা মনে আছে- একতারা হাতে এক বাউল।
সেজাপু তার 'ছোটবেলায়' আঁকা ছবিগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছে।
আমার করা হয়ে ওঠেনি।
ছোট থাকতে, যখন রোজা রাখাটা বাধ্যতামূলক ছিল না, তখন রোজা রাখতে খুব ভালো লাগত। কে কয়টা রোজা রেখে সমবয়েসী প্রতিবেশীদের কাছে গল্প করতে পারবে- এই ছিল প্রতিযোগীতা।
মাঝে মাঝে এমন হত- ঘুম থেকে উঠে দেখি সকাল আট-সাড়ে আটটা।
-"তাহলে সেহরি খেতে পারি নাই!"
এত মন খারাপ লাগত। কখনো আবার ডাইনিং রুমের শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। উঠে দেখি সেহরি শেষে সবাই প্লেট গুটাচ্ছে। কারো উপর রাগ করেও লাভ হত না। সেহরিতে না ডাকার সব ষড়যন্ত্র(!) ছিল আম্মুর।
ভাবতাম- "আমি কি আর একদম ছোট বাচ্চা, এমনিতেই তো কত সময় না খেয়ে থাকতে পারি।"
কারণ তখন রোজা (সাওম) অর্থ ছিল না খেয়ে থাকা। না খেয়ে থেকে সারাদিন সামনের মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে বাসায় আসতাম। মনে আছে, একদিন এমনি করে রোজা মুখে খেলা শেষে বাসায় এসে পাতিল থেকে ভাত নিয়ে তরকারি দিয়ে বেশ করে মাখিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে, ক্ষুধাও মিটে গিয়েছে, এমন সময় মনে পড়ল- "আরে! আমি না রোজা আছি!"
তারপর শেষের একটুখানি ভাত ফেলে দিয়ে মুখ ধুয়ে উঠে পড়লাম। কারণ বেখেয়ালে খেয়ে ফেললে রোজা ভাঙে না, এটা জানতাম।
আরেক রমজানের গল্প- আমি তখন ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়ি। আমাদের বাসার পাশেই স্কুল ছিল। স্কুলের দেয়ালে মিনা-রাজু, মিঠু, এইসব ছবি আঁকানোর জন্য আমাদেরই উপরতলার কেয়া চাকমাকে আনা হয়েছিল। আন্টি বসে বসে ছবি আঁকতেন, আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম, কোন কাজ থাকত না তো, তাই। তারপর দুপুর হয়ে গেলে চাকমা আন্টি(আমরা এ নামেই ডাকতাম) বাসায় চলে গেলেই আমরা গল্প শুরু করে দিতাম- চাকমারা কী সব জানি খায়- সাপ, কেঁচো আরও কত কী!
অথচ এখন যখন উনার বাবা রিটায়ার্ড সচিব মানুষটাকে দিনে দু-তিনবার বাজার করতে দেখি, আর দেখি যে আমি যা কিনি উনিও তা-ই কেনেন, তখন এটা ভাবলে হাসি পায় যে কল্পনায় তাদের কত বিতিকিচ্ছি জিনিসই না খাওয়াতাম!
সেহরিতে অবশ্য-খাওয়া ছিল দুধ-ভাত। খাওয়া শেষে দুধ দিয়ে ভাত মেখে খেতে হবে, কলা, চিনি বা গুড় দিয়ে। সেহরি শেষে ভাইয়া দাঁত মাজত, মেজাপু-ও।
এমনি সব রোজার গল্প.....
ছোটবেলার রোজাগুলোর কথা মনে পড়ে- খুব শীত ছিল ঐ সময়। সেহরি খেতে উঠে আমরা চাদর গায়ে বসতাম। বেডশিট না, ইরানে আম্মু যে চাদরগুলো ব্যবহার করত, সেগুলো। মেঝেতে মাদুর পেতে সবাই খেতে বসে যেতাম। চাদর গায়ে দিয়ে বসে পড়ে ঘুমে ঢুলতাম, শরীর চাইত শুয়ে পড়তে- মন বলত সেহরি খেতে। তাই অনেক কষ্ট হলেও জেগে থেকে বসে থাকতাম, ভাত খেতাম। জানালাগুলো দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকত। হালকা একটা ঘোরের মাঝে সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নালু লাগত তখন।
ইফতারের সময় আমরা দুটো বড় বড় ট্রেতে একসাথে আটজন খেতে বসতাম। বুট, মুড়ি, বেগুনি, পেঁয়াজু, এইসব। প্রতিবেশীরা প্রায়ই ইফতার পাঠাতেন। আমরাও পাঠাতাম। এখন আর তেমন প্রতিবেশী পাই না। সেই আটজন একসাথে বসে খাওয়াটা-ও শেষ হয়েছে। বাসায় আমরা এখন ছ'জন ইফতার করি একসাথে। মেজাপু বাসায় এলে সাতজন হয়। ভাইয়াতো দেশের বাইরে.....
হুমমম.....। তারপর? ইফতার শেষে নামাজ। এরপর রাত হয়ে যেত।
এভাবে কত বছর গিয়েছে জানি না। খুব বেশি না, কিন্তু মনে করতে গেলে মনে হয় অনেক। দু-তিন বছর আগের রমজানেও সেহরি খেয়ে উঠে ব্লগিঙ করতাম। ইফতার শেষে উঠে ব্লগ চেক করতাম- দেখিতো, আমার পোস্টে কোন নতুন কমেন্ট আসল নাকি! সেই সামহোয়্যারইন ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন হল। মাঝে মাঝে ব্লগীয় ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণ করতে ভালোই লাগে!
রোজার গল্পগুলো সব এমনি, একটু যেন শীত শীত ভাব আর পবিত্র এক অনুভুতি।
স্মৃতিহীন মস্তিষ্কেও যে কিছু স্মৃতি থাকতে পারে, ব্লগটা লিখে সেটা আবারও মনে হচ্ছে।
পবিত্র অনুভুতিগুলো সব এমনি থাক, নিউরন সেলগুলোর গহীনে।
আশা করি, আর ভুলব না।
নূরে আলম
১৯ অগাস্ট, ২০১০।
কিছুদিন আগে রাস্তার 'পরের ভ্যান থেকে শশা কিনছিলাম। এক প্রতিবেশী (ভূতপূর্ব!) আন্টির সাথে দেখা হল। আন্টি তার ছেলে জিসানকে নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন, দেখা হওয়ায় জিজ্ঞাসা করলেন- "এখনও কি তুমি আর্ট করো?"
মানুষ তো ছোট থেকে বড় হয়, বড় থেকে বুড়ো হয়। সময়ের দাগ পড়তে থাকে। কিন্তু কারো সাথে শেষ দেখাটা যদি হয় অনেক বছর আগে, মানুষ তখন সময়ের দাগের কথা ভুলে যায়, হঠাৎ দেখা হলে বলে- "তুমি এত বড় হয়ে গেসো?" কিংবা- "এখনও কি তুমি আর্ট করো?"
আমি আগে ছবি আঁকতাম।
গ্রামের দৃশ্য, কার্টুন ক্যারেক্টার, এইসব। ছবি এঁকে কার্ডে লাগিয়ে মুখোশ বানাতাম। মুখোশ বানিয়ে আমি, সেজাপু আর যীনাত একবার ঘর ভরে ফেলেছিলাম। আমার বানানো ভুতের মুখোশ যীনাত একবার স্কুলেও নিয়ে গিয়েছিল.....
এমনি এক ছবি আঁকা রমজানের কথা মনে পড়ছে। সেহরি খাওয়া শেষে আমি আর সেজাপু ড্রয়িঙ রুমের কার্পেটের 'পর বসে ছবি আঁকতাম। বোর্ডের বাংলা বই-এ যত ছবি, তার সব। আমি কী আঁকতাম- অতটা খেয়াল নেই, কিন্তু সেজাপুর আঁকা একটা ছবির কথা মনে আছে- একতারা হাতে এক বাউল।
সেজাপু তার 'ছোটবেলায়' আঁকা ছবিগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছে।
আমার করা হয়ে ওঠেনি।
ছোট থাকতে, যখন রোজা রাখাটা বাধ্যতামূলক ছিল না, তখন রোজা রাখতে খুব ভালো লাগত। কে কয়টা রোজা রেখে সমবয়েসী প্রতিবেশীদের কাছে গল্প করতে পারবে- এই ছিল প্রতিযোগীতা।
মাঝে মাঝে এমন হত- ঘুম থেকে উঠে দেখি সকাল আট-সাড়ে আটটা।
-"তাহলে সেহরি খেতে পারি নাই!"
এত মন খারাপ লাগত। কখনো আবার ডাইনিং রুমের শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। উঠে দেখি সেহরি শেষে সবাই প্লেট গুটাচ্ছে। কারো উপর রাগ করেও লাভ হত না। সেহরিতে না ডাকার সব ষড়যন্ত্র(!) ছিল আম্মুর।
ভাবতাম- "আমি কি আর একদম ছোট বাচ্চা, এমনিতেই তো কত সময় না খেয়ে থাকতে পারি।"
কারণ তখন রোজা (সাওম) অর্থ ছিল না খেয়ে থাকা। না খেয়ে থেকে সারাদিন সামনের মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে বাসায় আসতাম। মনে আছে, একদিন এমনি করে রোজা মুখে খেলা শেষে বাসায় এসে পাতিল থেকে ভাত নিয়ে তরকারি দিয়ে বেশ করে মাখিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে, ক্ষুধাও মিটে গিয়েছে, এমন সময় মনে পড়ল- "আরে! আমি না রোজা আছি!"
তারপর শেষের একটুখানি ভাত ফেলে দিয়ে মুখ ধুয়ে উঠে পড়লাম। কারণ বেখেয়ালে খেয়ে ফেললে রোজা ভাঙে না, এটা জানতাম।
আরেক রমজানের গল্প- আমি তখন ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়ি। আমাদের বাসার পাশেই স্কুল ছিল। স্কুলের দেয়ালে মিনা-রাজু, মিঠু, এইসব ছবি আঁকানোর জন্য আমাদেরই উপরতলার কেয়া চাকমাকে আনা হয়েছিল। আন্টি বসে বসে ছবি আঁকতেন, আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম, কোন কাজ থাকত না তো, তাই। তারপর দুপুর হয়ে গেলে চাকমা আন্টি(আমরা এ নামেই ডাকতাম) বাসায় চলে গেলেই আমরা গল্প শুরু করে দিতাম- চাকমারা কী সব জানি খায়- সাপ, কেঁচো আরও কত কী!
অথচ এখন যখন উনার বাবা রিটায়ার্ড সচিব মানুষটাকে দিনে দু-তিনবার বাজার করতে দেখি, আর দেখি যে আমি যা কিনি উনিও তা-ই কেনেন, তখন এটা ভাবলে হাসি পায় যে কল্পনায় তাদের কত বিতিকিচ্ছি জিনিসই না খাওয়াতাম!
সেহরিতে অবশ্য-খাওয়া ছিল দুধ-ভাত। খাওয়া শেষে দুধ দিয়ে ভাত মেখে খেতে হবে, কলা, চিনি বা গুড় দিয়ে। সেহরি শেষে ভাইয়া দাঁত মাজত, মেজাপু-ও।
এমনি সব রোজার গল্প.....
ছোটবেলার রোজাগুলোর কথা মনে পড়ে- খুব শীত ছিল ঐ সময়। সেহরি খেতে উঠে আমরা চাদর গায়ে বসতাম। বেডশিট না, ইরানে আম্মু যে চাদরগুলো ব্যবহার করত, সেগুলো। মেঝেতে মাদুর পেতে সবাই খেতে বসে যেতাম। চাদর গায়ে দিয়ে বসে পড়ে ঘুমে ঢুলতাম, শরীর চাইত শুয়ে পড়তে- মন বলত সেহরি খেতে। তাই অনেক কষ্ট হলেও জেগে থেকে বসে থাকতাম, ভাত খেতাম। জানালাগুলো দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকত। হালকা একটা ঘোরের মাঝে সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নালু লাগত তখন।
ইফতারের সময় আমরা দুটো বড় বড় ট্রেতে একসাথে আটজন খেতে বসতাম। বুট, মুড়ি, বেগুনি, পেঁয়াজু, এইসব। প্রতিবেশীরা প্রায়ই ইফতার পাঠাতেন। আমরাও পাঠাতাম। এখন আর তেমন প্রতিবেশী পাই না। সেই আটজন একসাথে বসে খাওয়াটা-ও শেষ হয়েছে। বাসায় আমরা এখন ছ'জন ইফতার করি একসাথে। মেজাপু বাসায় এলে সাতজন হয়। ভাইয়াতো দেশের বাইরে.....
হুমমম.....। তারপর? ইফতার শেষে নামাজ। এরপর রাত হয়ে যেত।
এভাবে কত বছর গিয়েছে জানি না। খুব বেশি না, কিন্তু মনে করতে গেলে মনে হয় অনেক। দু-তিন বছর আগের রমজানেও সেহরি খেয়ে উঠে ব্লগিঙ করতাম। ইফতার শেষে উঠে ব্লগ চেক করতাম- দেখিতো, আমার পোস্টে কোন নতুন কমেন্ট আসল নাকি! সেই সামহোয়্যারইন ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন হল। মাঝে মাঝে ব্লগীয় ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণ করতে ভালোই লাগে!
রোজার গল্পগুলো সব এমনি, একটু যেন শীত শীত ভাব আর পবিত্র এক অনুভুতি।
স্মৃতিহীন মস্তিষ্কেও যে কিছু স্মৃতি থাকতে পারে, ব্লগটা লিখে সেটা আবারও মনে হচ্ছে।
পবিত্র অনুভুতিগুলো সব এমনি থাক, নিউরন সেলগুলোর গহীনে।
আশা করি, আর ভুলব না।
নূরে আলম
১৯ অগাস্ট, ২০১০।
লেখাটা আসলেই দারুণ হয়েছে........ অনেক স্বত:স্ফূর্ত। পুরনো অনেক কথা মনে পড়ে গেল, আমি যখন রোজার কথা ভাবি কিঙবা লিখতে বসি, তখন হয়ত ঠিক এগুলো আগে মাথায় আসবে না। এখানেই পার্থক্য, এক একজন এক একটা স্মৃতিকে বেশি মনে রাখে।
উত্তরমুছুনঅনেক পুরনো কথা মনে পড়ে গেল........
ধন্যবাদ। রাত জেগে লিখেছি তো, এখন মাথা ঘুরছে। :)
উত্তরমুছুনভাল পোস্ট।
উত্তরমুছুনলেখাটা পড়ে অামারো স্মৃতিচারণ করতে মন চাইছে।
আমি আবার স্মৃতিহীন মানুষ তো, খূব কম জিনিসই মনে থাকে।
উত্তরমুছুন