আমার ক্লাসমেটদের কাছে এটাকে স্বাধীনতা খর্ব করা বলে মনে হতো, কিন্তু আমার এতে কোনো আক্ষেপ ছিল না। কারণ বাসার বাইরে থেকে আমার পাবার মত কিছু ছিল না: আমার প্রয়োজনীয় সবকিছু আমি বাসাতেই পেয়েছি।
না, এমন না যে আমাদের অনেক টাকা পয়সা ছিল আর খেলনা দিয়ে ঘর বোঝাই থাকত! বরং কোনো খেলনা বা কোনোকিছুর জন্য আবদারই করতাম না আমরা ভাইবোনেরা। কারণ আমরা ছোটবেলা থেকেই জানতাম, আমাদের সেই সামর্থ্য নেই। খুব টাকা-পয়সা কখনোই ছিল না, এখনও নেই।
মাঠে-ঘাটে খেলতে যাওয়া নেই, ঘরভর্তি খেলনা তো দূরের কথা, একটা টিভি পর্যন্ত নেই -- কেবল ঘরের ভিতরে আর ঘরের দরজা-জানালা দিয়ে আম্মুর চোখ যতদূরে যায়, ততদূর পর্যন্ত ছিল আমাদের চলাফেলার সীমানা। সমবয়েসী প্রতিবেশীদের সাথে খেলা বা গল্প -- সেটাও ঐ সীমানার ভিতরেই। শুনলে খুব নিরানন্দ মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের আনন্দের জায়গাটা ছিল অন্যখানে।
চিলের থেকে ছানাকে বাঁচানোর জন্য মা মুরগি ডানা দিয়ে বাচ্চাগুলোকে ঢেকে রাখে: সেই ডানার নিচেই আমাদের একটা ছোট্ট বাসা ছিল, ভাড়া বাসা। সেখানের একটা ঘরে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বই -- আর সেটাই ছিল আমাদের ড্রয়িংরুম। অনেক, অনেক বছর আমরা আটজন মানুষ সেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়েছি, তর্ক-বিতর্ক-আলোচনা করেছি। আরেকটা রুম ছিল, সেখানে আমরা মাদুর পেতে বসে খেতাম। রাতে, আটজন মানুষ একসাথে। সেখানে আলোচনা তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে সেটা ড্রয়িংরুম পর্যন্ত এসে তারপর সারা বাসায় ছড়িয়ে পড়ত। সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, পরিবার -- কী বিষয়ে আমরা মাথা ঘামাইনি?
স্কুলে পড়তে ক্লাসমেট ছেলে-মেয়েরা যখন প্রেম সংক্রান্ত জটিলতায় হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন হয়ত আমরা ড্রয়িংরুমে বসে 'ঙ' অক্ষরের সঠিক উচ্চারণ নিয়ে রাতভর ঝগড়া করছি। তারপর বিকেল হলে আম্মু রেস্ট নেবার সময় তাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আর্টিকেল পড়ে শুনিয়েছি -- ছোট দুই ভাইবোনের রুটিনওয়ার্ক ছিল এটা।
সমবয়েসীরা যখন সস্তা প্রেমের উপন্যাস পড়ছে, তখন আমরা শরৎ-রবীন্দ্র-বঙ্কিমে ডুবে থেকেছি, কিংবা অবসর সময়ে বাংলা অভিধান নিয়ে বিভিন্ন শব্দ আবিষ্কার করেছি। নিছক আগ্রহের বশে মধ্যযুগীয় গীতিকবিতা পড়েছি, যে বাংলা না শিখলে কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না। জ্যোতিষবিদ্যার বই হাতে পেয়ে সাড়ে সাতশো পৃষ্ঠা শেষ করে সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছিলাম -- জ্যোতিষী হবো!
এইসব করতে করতেই আমরা বড় হয়ে গিয়েছি। আমাদের গল্পটা যে আর সবার থেকে আলাদা - -তা বুঝিনি। বড় হয়ে উপলব্ধি করেছি, এক অনন্য পরিবারে জন্ম হয়েছে আমার। গোটা বাংলাদেশ খুঁজলেও হয়ত এমন পরিবার আর দ্বিতীয়টা পাওয়া যাবে না! আমি মোটেও বাড়িয়ে বলছি না বা অহংকার করে জাহির-ও করছি না, কিন্তু এটাই বাস্তব।
অথচ আম্মু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকতা করেছে, তার কোনোই প্রয়োজন ছিল না এই গল্প রচনা করার: নিজের উন্নত ক্যারিয়ার ছেড়ে দিয়ে "সংসার ধর্ম" করার। কিন্তু সেটা আম্মু করেছে। হ্যাঁ, আমার 'সাংবাদিক মা'-র সংসার ধর্ম আর সবার মত না -- আমাদের ধর্মীয়-নৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি আম্মু করে দিয়েছে, করেছে আব্বুও। অথচ এখনকার দিনের ক্যারিয়ারিস্ট বাবা-মা'র মত হলে? শুনেছি, আজকালকার দিনে মেয়েরা নাকি ক্যারিয়ারের জন্য বাচ্চা এবরশন পর্যন্ত করে। ক্যারিয়ারিস্ট বাবা-মা হলে আজকে বোধহয় গোটা বাংলাদেশে আমাদেরকে একনামে চিনত -- কিন্তু কী লাভ! হয়ত অনেক টাকা-পয়সা থাকত -- কিন্তু কী লাভ! আমার বাপ-মা শুধু মগজ বিক্রি করলে আজকে কোটি টাকায় ভাসত -- কিন্তু কেন তা না করে কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছিলো?
"নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে" -- এই বাক্যের উপলব্ধি জীবন দিয়ে করতে হয় -- এবং আলহামদুলিল্লাহ, সেটা আমরা করেছি। তাই অনেক বেশি অর্থোপার্জনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমি আমার জীবনপথকে এমনভাবে পরিচালিত করেছি, যেন আমার জীবনে প্রাচুর্য না থাকে, কিন্তু সেই স্বস্তিটুকু থাকে, যার কথা খোদাতায়ালা বলেছেন।
আটটা মানুষের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা আব্বু করেছে, সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আব্বু-আম্মু দুইজনে মিলে আমাদেরকে 'মানুষ' করেছে। আর আম্মু সেই সংসারে নিউক্লিয়াস হয়ে সবাইকে ধরে রেখেছে। সেই ডানার নিচেই বেড়ে উঠেছি: নাহলে কবে চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে যেত!
তারপর সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আমরা ভাইবোনেরা এক একজন নিজেদের স্বতন্ত্র্য ব্যক্তিসত্তার পরিস্ফূটন ঘটিয়েছি। এখন বাকিটা আমাদের নিজেদের পথ। সেই পথ যে সবার একই রকম হবে, তা না। আমাদের পরিবারের সেই উন্নত নৈতিক-আধ্যাত্মিক-বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থা যে carry on করবে, তা-ও বলা যায় না। তবে আমাদের সবারই সেই ভিত্তি আছে, প্রত্যেকের আছে, তা আমরা দিনশেষে চোখ বুঁজলে অনুভব করি।
সংসারজীবনে আমাদের সবারই যে আব্বু-আম্মুর মত "বিস্ময়কর ম্যাচ" হবে, তা বলা যায় না। আমরাও যে একইরকম উন্নতভাবে সন্তানকে গড়ে তুলতে পারব, তা-ও বলা যায় না। বরং বাস্তবতা হলো, তেমন চান্স খুবই কম। তখন আমাদের একা একাই হয়ত আব্বু-আম্মু দুইজনের দায়িত্বটা পালন করতে হবে। আম্মু হয়ে ডানা বিস্তার করতে হবে! কিন্তু তবুও, এই সুন্দর গল্পকে থামতে দিতে চাই না। যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আমি নিজ স্বকীয়তাকে বিকশিত করেছি, তারপর রচনা করেছি আমার নিজের মত গল্প -- সে ভিত্তিকে আমার নিজের ভিতরে বয়ে নিতে হবে। এভাবে করে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাব হয়ত একদিন।
আমার নিজেরও কিছু গল্প আছে, যা আমি আমার মত করে রচনা করেছি। যে গল্পটা কেবল শুরু হয়েছে: যার কিছু বলেছি, আর কিছু না বলা রয়ে গেছে। তবে দিনশেষে তা সুন্দরই হবে বলে আমার মনে হয়। কেননা -- নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে।
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
আমি এক বছর পর আবার এস্তোনিয়ায় এসেছি। গত একটা বছর আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। কিছু দিয়েছে যোগ করে, কিছু দিয়েছে বিয়োগ করে। আমাকে নাড়া দিয়ে দেখেছে, আমার ভিত শক্ত কিনা? আমি সেই পরীক্ষায় উৎরে গেছি। তখন খোদাতায়ালা আমাকে একটি সুন্দর গল্প উপহার দিয়েছেন। সে গল্পটাও আমার প্রিয়জনদের আমি বলব, একদিন বলব।
আমার অল্প কিছু ঘনিষ্ঠ মানুষ আছে, যারা আমার গল্প শুনতে ভালোবাসে, আমিও তাদের জন্যে গল্পকার হতে ভালোবাসি; তাদেরকে সাথে নিয়ে গল্প রচনা করি! সে গল্প কোনো বইয়ে না থাকলেও দুনিয়ার সেই জায়গাগুলিতে আছে, যেইখানে খোদাতায়ালার বসবাস! আর এতেই আমি খুব সন্তুষ্ট।
নূরে আলম
মার্চ ৯, ২০১৮
তালিন, এস্তোনিয়া।
(ছবিতে আব্বু, আম্মু, আর ভাইয়া। প্রায় ত্রিশ বছর মতন আগে, ইরানে তোলা।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
[ব্লগে কমেন্ট পোস্ট করার পরও যদি না দেখায়, তাহলে দ্বিতীয়বার পোস্ট করার প্রয়োজন নেই। খুব সম্ভবত স্প্যাম গার্ড সেটাকে সরিয়ে নিয়েছে, আমি পাবলিশ করে দেবো।]