সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিতর্ক, যুক্তি-প্রমাণ ও কোরআনের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য

বর্তমান যুগের "ইসলামের দিকে দাওয়াত" ও মহানবীর সময়ের "ইসলামের দিকে দাওয়াত" এই দুটির কিছু মৌলিক পার্থক্য অবশ্য-বিদ্যমান :

. মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন আল্লাহর রাসূল। তিনি বলতেন : "আমি একজন সুস্পষ্ট ভয় প্রদর্শনকারী মাত্র।" "আমি আল্লাহর রাসূল, তোমরা আমাকে মান্য করো।" "আমি আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছি তোমাদেরকে সতর্ক করার জন্য..."
আমরা কিন্তু এই কথাগুলো বলতে পারবো না। অর্থাৎ নিজেকে রাসূল দাবী করে কোরআনের বক্তব্য পেশকারীর কথার যে গুরুত্ব, আমাদের কথার অনুরূপ গুরুত্ব থাকবে না। আমরা কোরআনের কথা ব্যবহার করতে পারবো ঠিকই, কিন্তু নিজেকে রাসূল দাবী করতে পারবো না। এটি একটি মৌলিক পার্থক্য।

. আরেকটি পার্থক্য হচ্ছে, কোরআন ২৩ বছর ধরে নাযিল হয়েছিলো। গোটা কোরআন পড়লে দেখতে পাই যে, বিভিন্ন স্থানে মানুষকে আল্লাহর প্রতি আহ্বান করা হয়েছে, যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে আল্লাহর অস্তিত্ব কিংবা একত্বের ব্যাপারে। এখন, ইতিহাস থেকে আমরা যতটুকু জানি, তাতে এ সংক্রান্ত সকল আয়াত একত্রে নাযিল হয়নি, বরং সময়ের প্রেক্ষিতে এক এক সময়ে এক এক আয়াত (বা ক্ষেত্রবিশেষে গোটা একটা সূরা) নাযিল হয়েছিলো। সেক্ষেত্রে মহানবীর ইসলামের দাওয়াত কেমন ছিলো ? বর্তমান যুগে আমরা কিন্তু তাঁর যুগের অনুরূপ পরিবেশ (পাবো না বা ) তৈরী করতে পারবো না, এবং সেই অনুযায়ী কোরআন নাযিলের ধারাক্রম অনুসারে একটি-দুটি আয়াত বা সূরা প্রচার করতে পারবো না। আমাদের কাছে এখন সম্পূর্ণ গ্রন্থটি আছে। আর এই সম্পূর্ণ গ্রন্থটি-ই সরাসরি নাস্তিক, কাফির-মুনাফিক সকলের সাথে কথা বলতে সক্ষম। বর্তমান যুগে আমরা একজন বিধর্মীকে গোটা একটা কোরআন দিতে পারি পড়ার জন্য। মহানবী কিন্তু তেমনটা করেন নাই (কারণ তখনও কোরআন নাযিল হচ্ছিলো)। এটি আরেকটি মৌলিক পার্থক্য।

কিছুদিন আগের একটি ব্লগে লিখেছিলাম যে, "কোরআনকে স্রষ্টার গ্রন্থ প্রমাণের আগে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বজনীনভাবে স্রষ্টা, তথা আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোরআন, হাদিস কিংবা বিভিন্ন ব্যক্তির রেফারেন্স ব্যবহার করা যাবে না।" আজকের লেখাটা মূলত এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্যই।

এখানে আমার বক্তব্য এই যে, বর্তমান যুগে, এমনকি রাসূল (সা.) এর যুগেও যুক্তি এমন ছিলো না যে : "কোরআন এই এই বলেছে, অতএব মান্য করো।" এমন যুক্তি তাদের কাছেই গ্রহণযোগ্য, যারা মুসলমান। যারা কোরআনকে সত্য মানে, তাদের জন্য কোরআনের যেকোনো কথাই অবশ্য মাননীয়। কিন্তু যে ব্যক্তি বাইবেলে বিশ্বাস করে, তাকে কি এই কথা বললে কাজ হবে যে : "কোরআন বলছে মদ খাওয়া হারাম, সুতরাং মদ খাওয়া হারাম।" না ! কারণ সেতো কোরআনেই আস্থা রাখে না ! এমনকি মহানবী (সা.) - ও এভাবে যুক্তি উপস্থাপন করতেন না। বরং তিনি কোরআনের বাক্যগুলো সরাসরি ব্যবহার করতেন, উচ্চারণ করতেন।

এখানে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ্যনীয়। "If A, then B" (A সত্য হলে B-ও সত্য) কিংবা "as A, so B” (যেহেতু A সত্য, সেহেতু B-ও সত্য) এজাতীয় লজিক আমরা মুসলমানরা ব্যবহার করতে পারি। যেমন : "যেহেতু" কোরআন সত্য, "সুতরাং" মদ হারাম। কিন্তু একজন বিধর্মীর সাথে আমার প্রথম অংশে মতের মিল নেই। অর্থাৎ, সে "কোরআন সত্য" এই কথাটিতে বিশ্বাস করে না। সুতরাং সে "মদ হারাম", এটিও মেনে নিতে পারছে না। এক্ষেত্রে তার সাথে আমার যুক্তিতর্ক হবে এই নিয়ে নয় যে "মদ হারাম", বরং যেহেতু আমি মদ হারাম হওয়ার যৌক্তিকতাকে কোরআনের উপর নির্ভর করিয়েছি, সেক্ষেত্রে আমি কোরআনকে সত্য প্রমাণ করবো আগে।
সূক্ষ্ম পার্থক্যটি এখানে যে মুহাম্মাদ (সা.) কিন্তু সরাসরি কোরআনের আয়াত উচ্চারণ করতেন। ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে কোরআন তেলাওয়াত শুনে কিংবা রাসূলের মুখে কোরআনের একটি-দুটি বাক্য শুনেই মানুষ অশ্রুসজল হয়ে পড়তো এবং আত্মসমর্পন করতো। সূক্ষ্ম পার্থক্য এখানেই যে কোরআন সরাসরি সর্বজনীন গ্রাউন্ড ব্যবহার করে মানুষের সাথে কথা বলে। আর মুহাম্মাদ (সা.) ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সরাসরি কোরআনের বাক্যগুলি উচ্চারণ করতেন। তাঁর প্রচারিত বাক্যগুলো, অর্থাৎ কোরআনের আয়াতগুলো যুক্তিতে স্বতন্ত্র্য এবং স্ব-নির্ভরশীল। "যেহেতু কোরআন সত্য" এমন যুক্তির উপর নির্ভর করে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতেন না (rule of inference, modus ponens)

এই সূক্ষ্ম পার্থক্যের বিষয়টিই আমি বুঝাতে চেয়েছি। যেমন, কোরআন বলে না যে : "কোরআন নিজেকে ঐশী গ্রন্থ দাবী করে, সুতরাং তোমরা একে মান্য করো।" কিংবা "যেহেতু কোরআন বলে স্রষ্টা আছেন, এবং স্রষ্টা এক, সুতরাং তোমরা মান্য করো।" অর্থাৎ, কোরআন তার বিভিন্ন আয়াতের যুক্তিগুলোকে "যেহেতু কোরআন সত্য" এই কথার উপর ভিত্তি করে দেয় না। বরং প্রতিটা আয়াতই যুক্তিতে স্বতন্ত্র্য। আর এটিই হলো নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত যুক্তি। যেমন, স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে কোরআন বলছে :
"তারা কি কোনোকিছু (কোনো সৃষ্টি-উৎস/ সৃষ্টিকর্তা) ছাড়াই (নিজে নিজেই/ শূন্য থেকেই) সৃষ্ট হয়েছে, নাকি তারা (নিজেরাই নিজেদের) সৃষ্টিকর্তা?" (৫২:৩৫) সম্পূর্ণরূপে যুক্তিতে স্বনির্ভর একটি স্টেটমেন্ট।

মানুষের বক্তব্য ও প্রদত্ত যুক্তি থেকে আল্লাহর বক্তব্য ও প্রদত্ত যুক্তির পার্থক্য হচ্ছে যে, মানুষ ক্লাসিকাল লজিকে অভ্যস্ত (modus ponens : if A, then B) : "যেহেতু আব্বু বলেছেন, সেহেতু...” “যেহেতু হুজুর বলেছেন, সেহেতু...” “যেহেতু কোরআন বলেছে, সেহেতু...”
অবশ্যই আমরা মুসলমানেরা এজাতীয় ক্লাসিকাল লজিক ব্যবহার করতে পারি যে : “যেহেতু কোরআন বলেছে, সেহেতু...” (অর্থাৎ, যেহেতু A সত্য, সেহেতু B)। প্রশ্ন হলো, কোরআন কি নিজের সত্যতার ক্ষেত্রে অনুরূপভাবে ক্লাসিকাল লজিক ব্যবহার করবে ? নিশ্চয়ই না ! এবং করেও না। বরং কোরআন স্বয়ং তার অকাট্যতা ও ঐশীতা সম্পর্কে স্বনির্ভর যুক্তি প্রদান করে :
তারা কি লক্ষ্য করে না কোরআনের প্রতি ? পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো পক্ষ থেকে হতো, তবে অবশ্যই এতে বহু বৈপরীত্য দেখতে পেতো।(:৮২) কী চমৎকার স্বনির্ভর যুক্তি ! কোরআন তার নিজের ঐশীতা ও অকাট্যতা প্রমানে নিজের দিকেই নির্দেশ করছে ! অর্থাৎ :
কোরআন সত্য, এর প্রমাণ কী ?”
উত্তর : “কোরআন।”
আবারও, “সেই কোরআনের সত্যতার প্রমাণ কী ?”
উত্তর : “সেই কোরআন-ই।”

একারণেই কোরআন যুগে যুগে মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে, বিস্মিত করেছে, উত্তেজিত করেছে এবং আত্মসমর্পন করিয়েছে (মুসলমানে পরিণত করেছে)। কোরআনের কাছে এসে মানব মস্তিষ্কের সাধারণ যুক্তিশাস্ত্র স্তম্ভিত হয়ে পড়ে, কারণ মানুষ না নিজে কোথাও এমন স্বনির্ভর যুক্তি ব্যবহার করতে পারে, না সে কখনও আর কোথাও তেমনটা দেখেছে। কোরআন নিজের ঐশীতার ব্যাপারে নিজেকেই যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করছে ! যুক্তিশাস্ত্র / গণিতের ভাষায় অনুবাদ করলে ব্যাপারটা এমন : (If A, then A) যদি A সত্য, তবে A সত্য। অথবা, (A, A) যেহেতু A সত্য, সেহেতু A সত্য। অথবা, (A? A) A এর সত্যতার প্রমাণ কী ? উত্তর – A। সাধারণভাবে এই ধরণের যুক্তি কোনো মানুষ ব্যবহার করলে লোকে তাকে পাগল বলবে। (যেমন : “যেহেতু আমার কথা ঠিক, সেহেতু আমার কথা ঠিক।” কিংবা : “তোমার কথার প্রমাণ/যুক্তি কী ?” উত্তর – “আমার কথা-ই আমার কথার প্রমাণ।”)
এ ধরণের স্বনির্ভর যুক্তি কেবলমাত্র অনন্যভাবে কোরআনের জন্যই।

আমরা মুসলমানেরা কোরআনকে সত্য বলে মেনে নেয়ার পর আমরা কিন্তু অহরহ এই ক্লাসিকাল লজিক (যেহেতু A, সেহেতু B) ব্যবহার করি, এবং এটাই স্বাভাবিক – কারণ আল্লাহর মত করে যুক্তি উপস্থাপনে আমরা অক্ষম। এজন্যে আমরা বলি : “যেহেতু কোরআন বলেছে, সেহেতু মদ খাওয়া হারাম।” অর্থাৎ আমরা আমাদের স্বভাবগত লজিকে ফিরে যাই।

শা করি মানুষের প্রদত্ত যুক্তি থেকে আল্লাহর প্রদত্ত যুক্তির পার্থক্য বুঝাতে পেরেছি। এখন, মহানবী (সা.) যখন ইসলামের দিকে দাওয়ার দিতেন, তখন তাঁর মুখনিঃসৃত বক্তব্যই ছিলো কোরআনের আয়াত : যুক্তিতে অনন্য, স্বনির্ভর বক্তব্য। আমরা যখন ইসলামের দিকে দাওয়াত দেবো, আমরা যা করতে পারি তা হলো :
. কোরআনের স্বনির্ভর অনন্য যুক্তিপূর্ণ বাক্যগুলোকে পড়ে শুনাতে পারি। কিংবা আরো ভালো হয় যাকে দাওয়াত দিচ্ছি, তাকে গোটা একটা কোরআনই পড়ার জন্য দিয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে রাসূলের যুগে কোরআনের আয়াত যেমন মানুষের সাথে কথা বলতো (রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে), তেমনি এযুগে কোরআন মানুষের সাথে কথা বলবে (লিখিত-মুদ্রিত একটি গ্রন্থের মাধ্যমে)। অর্থাৎ রাসূলের দেয়া দাওয়াতের সাথে কার্যতঃ কোনো পার্থক্য থাকবে না। তাঁর সময়েও কোরআন সরাসরি মানুষকে সম্বোধন করে কথা বলেছে, আর এখনও বলছে। কেবল তখন কথাগুলো রাসূলের মুখনিঃসৃত ছিলো, আর এখন কথাগুলোকে আমরা মুদ্রিত অক্ষরে পাই – এটুকু পার্থক্য।
ব্যস, প্রথম উপায়ে দাওয়াতের ক্ষেত্রে কেবল কোরআনের একটি করে কপি বিলি করাই যথেষ্ট।
. দ্বিতীয় যে কাজটি আমরা করতে পারি, তা হলো যুক্তি-তর্ক করা, যা মহানবী (সা.) পরবর্তী যুগের অসংখ্য মনিষী করে গিয়েছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। নিশ্চিতই, তাত্ত্বিকভাবে এটা সত্য যে, যুক্তিতে অনন্য ও স্বনির্ভর কোরআন সরাসরি মানুষের সাথে কথা বলে যতখানি পরিবর্তন আনতে পারবে, মানুষের প্রদত্ত নিম্নমানের যুক্তি (inferior logic) ততখানি পরিবর্তন আনতে পারবে না। কিন্তু যদি আমরা সেটা করতে চাই, সেক্ষেত্রে আমরা কী করবো ?

নিশ্চয়ই আমরা মানুষের স্বভাবজাত ক্লাসিকাল লজিক ব্যবহার করবো। যেমন একজন মুসলমানের সাথে কোনো বিষয়ে দ্বন্দ্ব হলেই আমরা কোরআন উপস্থিত করি, তারপর যুক্তির সপক্ষে আয়াত দেখিয়ে বলি : “যেহেতু কোরআন বলেছে... সেহেতু...” – অর্থাৎ আমরা আমাদের স্বভাবজাত ক্লাসিকাল লজিকে (modus ponens : if A, then B) ফিরে যাই। এটা মানুষের দোষও নয় – এটা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। যেমন, আমরা যখন কোনো বই বা আর্টিকেল লিখি, তাতে ভূমিকা-উৎকর্ষ-উপসংহার ইত্যাদি থাকবেই। এটাই আমাদের স্বভাব যে আমরা "এক দেশে ছিলো এক রাজা” – এই সিস্টেমের বাইরে যেতে পারি না। কিন্তু অনন্য কোরআন অনুরূপভাবে শুরু হয়নি। কোরআন বলে না যে : “প্রথমে আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করলেন, তারপর ….।” কোরআনের নাযিলকৃত প্রথম কথাটি হলো : “পড় !” কিংবা সূরা ফাতিহার প্রথম বাক্যটি হলো : “সকল প্রশংসা বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহর।”

গুলো কোরআনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। একারণেই কোরআন মানুষের লেখা কোনো গ্রন্থ হতে পারে না, এবং প্রচলিত কোনো গ্রন্থের সাথেই তার আকৃতিতে মিল নেই। আর যুক্তির ক্ষেত্রেও কোরআন অনন্য ধরণের যুক্তি প্রদান করে। আমরা কেউ চাইলেই কোরআনের বর্ণনাভঙ্গিতে কোনো অর্থপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করতে পারবো না। আবার, আমরা কেউ চাইলেই কোরআনের মত অনন্য উপায়ে যুক্তি প্রদান করে কোনো বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো না। (এবং এটা অসম্ভব, কারণ সেক্ষেত্রে কোরআনের অনন্যতা বজায় থাকে না।)

অর্থাৎ মানুষ যদি বই লেখে কিংবা যুক্তি প্রদান করে, তবে সেটা মানুষের মত করেই হবে। সেটা কখনোই স্রষ্টার দেয়া যুক্তি বা অনন্য বর্ণনাভঙ্গির মত হবে না। হওয়া সম্ভব না। মানুষ চাইলেও পারবে না।

সেক্ষেত্রে আমরা যদি কোরআনের কপি বিলি করার বাইরে যুক্তি-তর্ক করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে আমাদের সীমিত ক্ষমতার ভিতরে থেকেই যুক্তিতর্ক করতে হবে। এবং আমরা তখন স্বাভাবিক পদ্ধতিতে যুক্তি প্রদান করবো :
. যেহেতু (A) মদ হারাম, সেহেতু (B) মদ দিয়ে তৈরী খাবারও হারাম। (প্রশ্ন : কেনো মদ হারাম ? Why A ?)
. (A) কোরআন বলেছে, অতএব (B) মদ হারাম। (প্রশ্ন : কোরআন কি সত্য ? A ?)
. এইখানে এসে আমাকে প্রমাণ করতে হবে যে কোরআন সত্য (অর্থাৎ A? A)। সেটা প্রমাণের জন্য হয় আমি অপর পক্ষের হাতে একটি কোরআন তুলে দিতে পারি, নতুবা তর্ক-বিতর্ক করতে পারি। কোনোটিই আল্লাহ নিষেধ করেননি। যদি আমরা তর্ক-বিতর্ক করি, সেক্ষেত্রে "যেহেতু কোরআন বলেছে” এই কথার উপর সবকিছুকে ভিত্তি করার আগে আমাদেরকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বজনীনভাবে কোরআনের ঐশীতা প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ এভাবে করে পিছনে যেতে যেতে এক পর্যায়ে ইসলাম, এবং তার পিছনে কোরআন, এবং তার পিছনে স্রষ্টাকে (আল্লাহ) নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বজনীননভাবে প্রমাণ করতে হবে।

এগুলো করতে হবে যদি আমরা যুক্তি-তর্ক করতে সম্মত হই। আর যদি তা না হই, সেক্ষেত্রে আমাদের আর অন্যের সাথে কোনোরূপ যুক্তি-তর্ক করার (reasoning) সুযোগ থাকবে না। সেক্ষেত্রে আমরা (সরাসরি কোরআন থেকে বা অন্য যেকোনোভাবেই হোক) আল্লাহ, কোরআন, ইসলাম, রাসূল – ইত্যাদি ব্যাপারে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন করে নীরবে নিজের কাজকর্ম করতে থাকবো। কিন্তু যদি আমরা যুক্তিতর্ক করতে চাই, সেক্ষেত্রে মানুষের প্রচলিত নিয়ম-কানুনের বাইরে গিয়ে আমরা যুক্তি প্রদান করতে পারবো না। সেক্ষেত্রে উপরের নিয়মেই করতে হবে। এবং আমরা যে যুক্তি-ই উপস্থাপন করি না কেনো, মানুষ উপরের নিয়মেই প্রশ্ন করবে, এবং আমাকে ঐ নিয়মের অধীন যুক্তি-তর্কে প্রবেশ করিয়ে ছাড়বে। এটাই স্বাভাবিক, মানুষের বৈশিষ্ট্য। আর আমরা যদি মানুষের স্বভাবজাত ধরণের যুক্তিতর্ককে পরিহার করি, সেক্ষেত্রে যুক্তির আর একটি উৎস বাকি থাকলো, তা হলো আল কুরআন। সেক্ষেত্রে আমাদের যুক্তি-তর্ক করার কোনোই প্রয়োজন নেই – কোরআন নিজের পক্ষে নিজেই কথা বলতে সক্ষম।

অর্থাৎ, আমরা যেকোনো বিষয়ে, এমনকি কোরআনের অকাট্যতা সম্পর্কে হলেও, "যদি যুক্তিতর্ক করে প্রমাণ উপস্থাপন করতে চাই", সেক্ষেত্রে আমাদেরকে প্রচলিত যুক্তিতর্কের ধারা-ই ব্যবহার করতে হবে। অন্য কোনো প্রকার যুক্তিপ্রদান আমাদের ক্ষমতার বাইরে। যুক্তির অন্য ধরণ, যা সফলভাবে মানুষকে কনভিন্স করতে সক্ষম, সেটি কেবল আল্লাহ প্রদত্ত অনন্য পদ্ধতির যুক্তি। আর সেটি আল্লাহ তা'আলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থেই দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব হলো অনন্য যুক্তি-প্রমাণের এই গ্রন্থটিকে সকলের কাছে উপস্থিত করা।

কোরআন, ইসলাম কিংবা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে যুক্তি-তর্ক (reasoning) বা যুক্তিশাস্ত্রের অপরিহার্যতা বুঝাতে সক্ষম হয়েছি আশা করি। যদিও এর অবস্থান ও স্কোপ ভিন্ন আলোচনার দাবী রাখে।


নূরে আলম
সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৩।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা