সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ছোট অ্যাপারচার থেকে



আমি ইদানিং গান শুনি না। গান শোনাকে অহেতুক কাজ বলে মনে হয়। মনে হয়, এতে চিন্তার ফোকাস সরে যায়। মানুষের মনের দূর্বল দিকগুলো জেগে উঠতে চায়। মাটির নিচ থেকে কেউ উঠে আসতে চায় যেনো। তাই আমি গান শুনি না। দিনের মধ্যে কয়েকবার নিজের মনে বলি -- Focus ! Concentrate !

ব্লগার চিন্তা ঝাড়ার জায়গা না। আমার পরিচিত এক ব্লগার আছে, সে ব্লগারকে মনে করে চিন্তা ঝাড়বার জায়গা। ব্লগারে এসে যত এলোমেলো বিচ্ছিন্ন ভাবনাগুলোকে ঝেড়ে ফেলে নিজের জীবনটাকে, চিন্তাগুলোকে ঠিক-ঠাক রাখে। সে বলে -- ব্লগের আমি আর বাস্তবের আমি আলাদা। গার্মেন্টস এ কাপড় তৈরী হবার পর যে এলোমেলো আকৃতির কাপড়ের টুকরো বের হয়, সেগুলো যেনো সে তার ব্লগারে সাজিয়ে রেখে যায়।

আমার বানানো কাপড়গুলোয় আমি অমনটা হতে দিই না। আমি তাদের নিখুঁত চাই। আমি চাই না তাদের বানাবার সময় কতগুলো উচ্ছিষ্ট বেরোক, যাদের নিয়ে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়বো ! আর আমি জানিও না কোথায় তাদের রাখতে হয়, না ফেলতে হয়।

ব্লগে এমন অ্যামবিগিউয়াস কথা লেখা ঠিক না। অনেকে ব্লগ পড়ে। ভদ্রতা করে পড়ে। আগ্রহ করে পড়ে। সার্চ করতে এসে ল্যান্ড করলে পড়ে। হাবিজাবি কথা দিয়ে অপরের সময় নষ্ট করা ঠিক না।

আমি ইদানিং কিছুই লিখতে পারছি না। অথচ অনেকগুলো ব্লগ লেখা দরকার। হ্যাঁ, ব্লগ -- "লেখা দরকার"। সোডিয়াম বাতির আলোর নিচ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন কতগুলো ভাবনা এসে ব্লগ রচনা করে দিয়ে যায়, কম্পিউটার পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে তারা হারিয়ে যায়। কিংবা বইমেলা থেকে ফিরবার পথে বাসার খুব কাছে এসে একযুগের বেশিদিনের পরিচিত রাস্তাটা দিয়ে রিক্সায় আসতে আসতে যখন ক্লান্ত দেহমনে ভাবি -- সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা নেমেছে, তখন সে ভাবনাগুলো সুন্দর হয়ে ওঠে, আর সেই সাথে অনেকগুলো কথাকে জড়িয়ে ফেলে। কীবোর্ডে এসে তারা হারিয়ে যায়।

আজ বইমেলায় গিয়েছিলাম।
আমার কয়েকটা বইমেলার কথা মনে পড়ে। যীনাত, আমি আর আব্বু, আমি আর আব্বু, এবং আর কয়েকটা। ছোটবেলায় তিন ভাইবোন টাকা জমিয়ে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করতাম। সেই জমানো টাকা দিয়ে সেরা সায়েন্স ফিকশান, জুল ভার্ণ কিংবা এজাতীয় আরো কিছু বই কেনা হতো। এখন সেই পাঠক সত্ত্বাটি হারিয়ে গিয়েছে। আমার ফোকাস সরে গিয়েছে। কিংবা ক্যামেরার অ্যাপারচার ছোট হয়ে এসেছে। এখন আর বই পড়া হয় না। এমনকি শরৎ-রবীন্দ্র-নজরুলও না। সস্তা ঝালমুড়ি হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল -- এগুলোও না, প্রশ্নই ওঠে না !
আজ বইমেলায় গিয়ে একথাই ভেবেছি। পুরোটা যাবার পথ বন্ধুদের সাথে কথা বলেছি, আর মনে মনে এসব চিন্তা করেছি। প্যারালাল প্রসেসিং। ফুলার রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে লিমন বলছিলো -- এই যে এই রাস্তা দিয়ে কত মানুষ হাঁটছে, অথচ এক এক জনের মনে এক এক রকম চিন্তা !
আমি বললাম -- হ্যাঁ, সেটাই তো স্বাভাবিক !
আসলে ঠিক সেই মুহুর্তে আমি এমনই সব irrelevant চিন্তা করছিলাম যে ওর কথায় চমকে উঠেছি। মুহুর্তের জন্যে মনে হয়েছে -- আমার মনের কথা পড়ে ফেললো নাকি ?
ফয়জুল আমার কথা শুনে মৃত্যুক্ষুধা বইটা কিনেছে। আমি বলেছি -- দারিদ্র এক্সপেরিয়েন্স না করলে এ বইয়ের স্বাদ পূর্ণ আস্বাদন করা যাবে না। তবে সে কিনেছে। আমার কথা শুনে কিনেছে।
সজীব সারাটা পথ ফয়জুলের বক্স ফাইল হাতে হেঁটেছে। বই, বইমেলা -- এগুলো তার কাছে তেমনই পানসে, যতটা পানসে আমার কাছে ক্রিকেট। আমি বিস্মিত হয়ে দেখছি -- আমার ফেসবুক, ইয়াহু কিংবা গুগল চ্যাটে সব মিলিয়ে দুই-চারজনও অনলাইন নেই ! কারণ এখন সবাই BPL দেখছে। আমি ক্রিকেটের ব্যাপারে ততটাই উদাসীন, যতটা উদাসীন সজীবকে মনে হয় পলিটিক্সের ব্যাপারে, তার প্রশ্ন শুনে -- প্রেসিডেন্ট কে ?

আমি কখনো বনলতা সেনের দৃষ্টি দেখি নি। স্কুলে একটা মেয়ে ছিলো, তার চোখের পাঁপড়িগুলো কত বড় বড় ছিলো ! কিন্তু না, সে বনলতা সেন হতে পারে না কিছুতেই। আমি সত্যিই সে দৃষ্টি দেখি নি। তবে, আমি কল্পনা করেছি। আমি যখন পড়ি :
শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের -- ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;
'মনে আছে ?' শুধালো সে -- শুধালাম আমি শুধু, 'বনলতা সেন ?'

তখন আমি কল্পনা করি : বহু পথ পার করে আসা ক্লান্ত পথিক, যখন তার জেগে থাকবার সমস্ত সময় পার হয়ে গিয়েছে, পরিচিত সেই পথ ধরে যখন বাড়ির পথে হাঁটছে সে, তখন হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চমকের মত দেখা হলো বহুদিনের পুরনো এক পরিচিতের সাথে। কতদিন পর দেখা ! কিন্তু বিদ্যুৎ চমক তাকে চমকিত করে না, সে শুধু ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়। পরিচিত মানুষটি তার সেই চোখ তুলে তাকায়, যে চোখের কথা একসময় লেখা হয়েছিলো -- সেই চোখ। সে-ও ততদিনে ক্লান্ত পথিক, এখন তারও শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ -- ধুলোপড়া ব্যাকুলতা কন্ঠে বলে, "মনে আছে ?" পথিক শুধু জিজ্ঞাসে -- "বনলতা সেন ?"


আমার সে অদ্ভুত কল্পনা সত্য হয় নি। আমি বনলতা সেনের দৃষ্টি দেখি নি। তবে আমি নিষ্ঠুর দৃষ্টি দেখেছি। যে চোখ হাসলেও নিষ্ঠুর, কাঁদলেও নিষ্ঠুর -- সেই চোখ। সে চোখ আদতে বড় করুণ, কারণ সে বদলাতে জানে না।

আমার শুধু নিজের চোখটাকেই জানা হয় নি।


নুরে আলম,
ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১২।

মন্তব্যসমূহ

  1. মাহমুদ ফয়সালের একটু উদাস ব্লগ না পড়লে আমার এ লেখাটাও বেরোতো না।
    https://mahmudfaisal.wordpress.com/2011/05/06/ektukhani-udash/

    উত্তরমুছুন
  2. hmm shundor mashaallah. :) kintu ami oi typer manush - jara blogger e eshe chinta jhare. :|

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. হুম, ঐ টাইপের মানুষ কেনো -- আমি তো তোমার কথাই লিখেছি :)

      মুছুন
    2. :O humm.. but blog er ami ar bastober ami alada eta kobe bolsi? i think 'mira' ar ami alada.. but L ar ami pretty similar. :P

      মুছুন
    3. কবে বলসো ? উমম... গতবছর। মাস-তারিখ বলতে পারবো না, অনেক ঝামেলা।
      L আর তুমি pretty similar ? কী জানি ! ভোল পাল্টে গেছে মনে হয় :p

      মুছুন
  3. হ হ হ... ভালো ল্যাখছ ভাই!

    তোমার চোখ কেমন আমি বলতে পারি, এক চোখ করুণ, এক চোখ ধূর্ত! ;)

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. তবে এক চোখে থাকবে সানগ্লাস, আরেক চোখে শুধু চশমা ! :)

      মুছুন
  4. অসাধারণ। মসকরা করার মুডও হারিয়ে ফেলেছি, লেখাটা এতোটাই চমৎকার :)

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

[ব্লগে কমেন্ট পোস্ট করার পরও যদি না দেখায়, তাহলে দ্বিতীয়বার পোস্ট করার প্রয়োজন নেই। খুব সম্ভবত স্প্যাম গার্ড সেটাকে সরিয়ে নিয়েছে, আমি পাবলিশ করে দেবো।]

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা