সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জান্নাতের পথে চলো...

১.

“ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদ” -- নানাজীর মুখ থেকে এই কথাটাই আমি সর্বশেষ শুনেছি। দরুদের শুরুর অংশটা পড়ছিলাম আমি, আর শেষ অংশটা নানাজী। ঠাণ্ডা লেগে বুকে কফ বসে গিয়েছিল; কারো সাথে কোনো কথা বলছিলেন না, শুধু মাথা নেড়ে আর ইশারায় কথা। কিন্তু আমি যখন বললাম, নানাজী, আমার সাথে সাথে দরুদ পড়েন, দরুদ পড়লে চোখের জ্যোতি বাড়ে -- তারপর আমরা অর্ধেক-অর্ধেক করে দরুদ পড়লাম। ওটাই ছিল নানাজীর সাথে আমার শেষ কথা। কতই না সুন্দর সে কথা!
“আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ”
- “ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদ।”
মুহাম্মদের (সা.) উপর দরুদই হলো সেই একটিমাত্র কাজ, যা আল্লাহ নিজে করেন, তাঁর ফেরেশতাকুল করেন এবং পাশাপাশি মুমিনগণকে সেই কাজে শামিল হতে আদেশ করেন। দরুদের অনেক মর্তবা। নানাজী এসব জানেন।
তারপর আমার তসবিটা নানাজীর হাতে দিয়ে দিলাম। চলে আসার আগদিয়ে দেখলাম নির্জীব হয়ে শুয়ে আছেন, কিন্তু তসবি পড়ছেন।

সেদিন ঢাকা মেডিকেলে নানাজী ভর্তি হবার দ্বিতীয় দিন; ছোট খালা আর আমার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। প্রথমদিনও গিয়েছিলাম, আম্মুকে নিয়ে। তখন দেখেছি সাততলায় ৩ নং লিফটের সামনে মেঝেতে নানাজীকে রেখেছে। চারিদিকে পুলিশ, কাছে যাওয়া যায় না। পরদিন একটা বেডে স্থানান্তর করা গেল, তবুও পুলিশের দুর্ব্যবহারে বেশিক্ষণ কাছে বসা যায় না। নানাজী বসতে চাইলেন, মুন খালাম্মা তাঁকে ধরে বসে থাকতে সাহায্য করল। খালাম্মা নানাজীকে ডেকে কিছু একটা বলছিল, নানাজী কোনো ইশারা করছেন না, মাথা নাড়ছেন না -- হাতের দিকে লক্ষ্য করে দেখি নামাজ পড়ছেন। বললাম, নানাজী নামাজ পড়তেছে; এই নামাজের জন্যই তো আজকের এত কষ্ট। আমরা একটু অসুস্থ হলেই নামাজ কাজা পড়ি, আর দেখেন এই অবস্থাতেও নানাজী নামাজ পড়তেছে।

পাঁচবারের নির্বাচিত এমপি নানাজী। অল পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশ -- উভয় সময়েই সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন একাধিকবার করে। উভয় দেশেরই নানান শাসকের হাতে নানাভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষবার ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘যুদ্ধাপরাধ’ মামলা দেখিয়ে আটক করে ও এক পর্যায়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। সাড়ে সাত বছর জেল-জুলুম পার করে অবশেষে ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ শুক্রবার জুম্মার সময়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় মাজলুম অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। যেই বাংলাদেশের জনগণের জন্য তিনি এত খেদমত আঞ্জাম দিলেন, সেই দেশই তাঁকে মাজলুম করল।

অবশ্য এ আর নতুন কী -- মুহাম্মদী পথ মানেই এটা। আমাদের দুঃখ-কষ্ট তো তাঁর তুলনায় কিছুই না। যেই উম্মতের জন্য রাসুল (সা.)-এর এত কষ্ট, সেই মুসলমানরাই তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর মেয়ে ফাতেমা (সা.আ.), চাচাতো ভাই আলী (আ.) ও তাঁদের বংশের আরো দশ পুরুষকে হত্যা করেছে। খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামকে বিলুপ্তপ্রায় করে দিয়েছে। তবু এই উম্মতের জন্যই তিনি কাঁদেন, আল্লাহর কাছে শাফায়াত করেন। আল্লাহপাক কুরআনে বলেন, “যারা ঈমান আনে না, তাদের জন্য দুঃখে আপনি না আবার শেষ হয়ে যান” -- কিন্তু তিনি তো রাহমাতুললিল আলামিন। তাই সারাদিন এসব মানুষের জুলুম নির্যাতন সহ্য করে রাত্রিবেলা ঘুম থেকে উঠে আবার তাদের জন্যই আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেন। আর আল্লাহ কাঁদেন তাঁর হাবীবের কষ্ট দেখে। এটাই হলো সেটা, যাকে বলা হয় ‘ভালবাসা’; ভালবাসার চুড়ান্ত চিত্র। এই ভালবাসার আগুনের ফুলকি পৃথিবীর যাদের বুকেই এসে পড়ে, তারাই আল্লাহ-ঘনিষ্ঠ হয়ে যান। আল্লাহপাক বলেন, “নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও আমলে সালেহ (সৎকর্ম, উপযুক্ত কর্ম) করে, করুণাময় (আল্লাহ) তাদের জন্য (মুমিনদের অন্তরে) ভালবাসা দান করবেন।”

আর আমার নানা মাওলানা আবদুস সুবহানের জন্য আল্লাহপাক মানুষের অন্তরে কতটা ভালবাসা জারি করে দিয়েছেন, তা জানতে হলে আপনাদেরকে পাবনায় যেতে হবে, পাবনাবাসীর সাথে কথা বলতে হবে। পরদিন ১৫ই ফেব্রুয়ারি জানাজার নামাজ শেষে আম্মু, বড়াপু ও এক খালা আর কয়েকজন কাজিনকে নিয়ে বের হবার সময় দারুল আমান ট্রাস্টের গেটের কাছে দেখলাম এক অন্ধ ভিক্ষুক, সাথে তার স্ত্রী, উভয়েই অত্যন্ত বৃদ্ধ -- আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমি কাছে যাবার পর মহিলাটা কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “আমি কত ঢুকতে চাইসি, হারামজাদা দারোয়ান আমাক য্যাবের দ্যায় নাই, আমি মলানার মুখখান দেকপের পারলাম না।” (“আমি ঢুকতে চেষ্টা করেছি, দারোয়ান আমাকে যেতে দেয়নি, মওলানার মুখটা আর দেখতে পারলাম না।”)

এরকম অসংখ্য গল্প আছে, অগুনতি। কিন্তু আমি সেসবের গল্প কখনো করিনি, এখনও করব না। মওলানা আবদুস সুবহানের মহত্বের গল্প আর সবাই করলেও, পরিবারের লোক হিসেবে আমি তা করতে পারি না। আর সবাই কাঁদলেও আমি কাঁদতে পারি না; পাছে না আবার সে অশ্রু ‘লিল্লাহে রাব্বিল আলামিন’ না হয়ে এই জন্যে হয় যে, সে ‘আমার নানা’!

 কিন্তু তাতে সত্য বদলায় না। নানাজীর বিরুদ্ধে শাহবাগীদের এতদিনের মিথ্যাচার, কিংবা আজকে জামায়াতে ইসলামীর বিবৃতিতে তাঁর প্রশংসা -- কোনো কিছুতেই সত্য বদলায় না। কোনো কিছুতেই বদলে যায় না নিরপরাধ মানুষ হত্যার পিছনে শাহবাগীদের কালেক্টিভ পাপ, কিংবা বদলে যায় না নানাজীর সাথে জামায়াতে ইসলামীর আচরণ কিংবা কিছু নিতান্তই কাছের মানুষদের আচরণ। আজকে ওহাবীয়াতের খপ্পরে পড়ে নানাজীর কবর সংরক্ষণের অভাবে যদি একদিন হারিয়েও যায়, হারিয়ে যায় তার জীবনেতিহাস -- তাতেও বদলে যায় না বাস্তবতা, কেননা সত্য তো সত্যই। আর আমার নানা মাওলানা আবদুস সুবহানের সম্পর্কে যতটা সত্য আমরা জানি, তাতে উত্তম ব্যতীত আর কিছু ছিল না। আর সে উত্তম কথাগুলি খোদাতায়ালার অবিনশ্বর খাতায় লেখা আছে।

আমরা শঙ্কিত ছিলাম প্রশাসন আমাদেরকে জানাজার নামাজ ঠিকমত পড়তে দেবে কিনা -- আলহামদুলিল্লাহ, কোনোধরণের অসুবিধা তাদের দিক থেকে আমরা পাইনি। যদিও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের একটি মাঠে সব মানুষের স্থান সঙ্কুলান সম্ভব হয়নি; মানুষজন পিছনের মাঠ এবং বাড়ির ছাদ ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে নামাজে অংশগ্রহণ করেছে, এবং মাইকিং করতে না পারার কারণে বহু লোকে জানাজায় অংশ নিতে পারেনি।

ইন্তেকালের পর ঢাকা মেডিকেলে নানাজীকে স্ট্রেচারে শোয়ানো দেখেছি, আলহামদুলিল্লাহ! এত সুন্দর চেহারা! আমার মনটা ভরে গেছে। সুসংবাদ দানকারী ফেরেশতারা এসে নিয়ে গেছে, খোদার মেহমান করে। নানাজী গ্রেফতার হবার পর আমি বহুবার স্বপ্নে দেখেছি নানাজীর বাড়িতে পুকুরপাড়ে নানাজী হাঁটছেন, সাথে তাঁর সন্তান-নাতি-নাতনিদের মাঝে কেউকেউ আছে। খুব সুন্দর, হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল আনন্দময় পরিবেশ। আমার খালাতো ভাই, বন্ধু সালমান, আরেক খালাতো ভাই জাওয়াদ, আরেক খালাতো ভাই মুনাওয়ারসহ আরো যতজন ইতিমধ্যেই আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছে, তারা মিলে এখন নানাজীর সাথে ঘুরছে, হাঁটছে, বিশ্রাম করছে। কোথায়? সেই পাবনার বাড়িতেই। জালালপুরের পুকুরপাড়ে। টিনশেড ঘরটাতে। ঐ জায়গাগুলিতেই।

বেহেশত কেমন? এই পৃথিবীর মতনই। সেখানের মানুষ কেমন? এই পৃথিবীর মানুষের মতনই হাত-পা-চোখ সবকিছু। মৃত্যু থেকে শুরু করে শেষ বিচারের আগ পর্যন্ত সময়ে মানুষ (অর্থাৎ তাঁর আত্মা) কোথায় থাকে? আলমে বারযাখ তথা পর্দার ওপারের জগতে থাকে। চুড়ান্ত বিচার ও ফায়সালার আগেই যারা ভালোমানুষ, তাদেরকে ভালো পরিবেশ দেয়া হয়, আর যারা খারাপ মানুষ, তাদেরকে দেয়া হয় খারাপ পরিবেশ। এই মুহুর্তে আমাদের প্রিয় মৃত ব্যক্তিরা কোথায় আছেন? সেই আলমে বারযাখে। সেই জগতটা কেমন, তা আপনারা জানেন। মৃত পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন প্রিয়জনদের সাথে সেই জগতে মানুষের দেখা হয়, কথা হয়। কেবল জ্ঞান ও পবিত্রতার অভাবে আমরা তা অনুধাবন করতে পারি না। আমরা যত বেশি জ্ঞান অর্জন করব ও পবিত্র হব (তথা মারেফাতুল্লাহ অর্জন করব), তত বেশি বারযাখের জগত আমাদের কাছে বাস্তব হয়ে উঠবে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা ততই সহজ হবে। প্রিয়জনের ইন্তেকালের শোক সহ্য করাও ততই সহজ হবে। তখন আমরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারব যে, বরং এই দেহটাই কবর, এই দেহকে ত্যাগ করার মাধ্যমেই সালেহীনগণ (সৎ ও উপযুক্ত কর্ম করেছেন, এমন ব্যক্তিগণ) পরিপূর্ণ জীবিত হয়ে ওঠেন।

জালেমরা নানাজীর পোস্টমর্টেম করেছে। ঢাকায় আমরা আত্মীয় স্বজন যতজন ছিলাম, একটা বাস রিজার্ভ করে রাত একটায় পাবনা গিয়ে পৌঁছেছিলাম আগেই -- সব প্রসিডিউর শেষ করে ঘন্টা তিনেক পরে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে করে নানাজীকে আনা হলো। সাদা কাপড়ে মোড়ানো। কিন্তু রক্তের ছাপ। এখনো রক্ত গড়াচ্ছে, কেননা তারা পোস্টমর্টেম করেছে। শহীদের রক্তপাত না করলে জালিমের জুলুম পুরা হয় না, অপরদিকে খোদার তরে রক্ত ঢেলে দেবার জন্য গোটা জীবনই উদগ্রীব থাকেন শহীদেরা।

এই পোস্টমর্টেম জিনিসটা সবাইকে কাঁদালো। কপালের কাছদিয়ে কেটেছে তারা -- সেখান থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। কিন্তু এ আর কতটুকু জুলুম, রাসুল (সা.)-এর নাতি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর দেহমোবারকের উপর দিয়ে জালিমরা ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছিল, পবিত্র মাথাটি কেটে নিয়ে জালিম ইয়াজিদের দরবারে উপস্থাপন করেছিল, এবং তাঁর পরিবারকে লাঞ্ছিত করেছিল -- এর চেয়ে বেশি জুলুম আর কী হতে পারে!

সেই ভোররাতেই লন্ডন থেকে ভাইয়া, তারেক ভাইয়া, এস্তোনিয়া থেকে শোয়েব ভাইয়া ভিডিও কলে জয়েন করল। তারা কেবল তাকিয়েই আছে, কিছু বলতে পারছে না। ফ্রিজিং গাড়ির ভিতরে বরফ শীতল, সেখানে নানাজী শুয়ে আছে -- না, তাঁর দেহটাকে রাখা আছে, তিনি তো আলমে বারযাখে দুনিয়ার জীবনের চেয়ে অনেক বেশি সুখ, শান্তি ও আনন্দে আছেন। ফ্রিজিং গাড়ির একপাশে একটুখানি কাঁচ, সেখান দিয়ে মাথাটুকু দেখা যায়। আম্মু নেমে এলো উপর থেকে, আবারও দেখার জন্য। আম্মু নানাজীর বড় সন্তান। আম্মু লৌহমানবী, তবুও এটা বড়ই কঠিন এক দৃশ্য। আম্মু দাঁড়িয়ে কুরআনের আয়াত পাঠ করছে: “ইয়া আইয়্যাতুহান নাফসুল মুতমাইন…” আমি আম্মুকে শুধু বললাম, নানাজীকে নেবার জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) আসবেন, ইমাম হুসাইন (আ.) আসবেন। কতই না সৌভাগ্যের বিষয় সেটা!



২.

লক্ষ লক্ষ লোকের অংশগ্রহণে নানাজীর জানাজা হলো, দাফন হলো। বাসায় ফিরে ফোন অন করলাম, মোর্শেদ ইনবক্সে কোনো এক ফেইসবুক পোস্টের কমেন্টের স্ক্রিনশট পাঠিয়েছে। সেখানে কোনো এক প্রবাসী জামাত সমর্থকের পোস্টে ক্ষুদ্র গণ্ডীর ওহাবী-সালাফিরা আমাকে নিয়ে মেতেছে। লিখেছে, “উনার নাতি শিয়া, উনার পরিবার আহলে সুন্নাহ, এটা অবিশ্বাস্য।” তারপর সেখানে আমার প্রোফাইলের স্ক্রিনশট, যেখানে প্রোফাইল পিকচারে ইমাম খোমেনীর (র.) ছবি দেয়া। যদিও আমি আমার নানা কিংবা বাবার সম্পর্কে আলাদাভাবে লেখালেখি করে ফেইসবুকবাসীকে জানাই নাই, তবুও কূপমণ্ডুক (কুয়ার ব্যাঙ) সালাফিরা আমাকে নিয়ে গবেষণা করে গোয়েন্দা রিপোর্ট রেডি করে ফেলেছে একেবারে।

সেটা অবশ্য দেখেছিলাম ২০১৭ সালেই, যখন আমি ‘স্রষ্টাভাবনা’ বইটি অনলাইনে প্রকাশ করি। হার্ডকপি প্রকাশ করার আর্থিক সামর্থ্য আমার ছিল না, তাই পিডিএফ প্রকাশ করি। আর সে বছরই আস্তিক-নাস্তিক রেসলিং শো দেখিয়ে ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে বই বেচাবিক্রি একদম তুঙ্গে -- আরিফ আজাদের প্যারাডক্সিকাল সাজিদ বই দিয়ে যার শুরু। সেই লেখকগোষ্ঠীর কাছে আমার বই পৌঁছে গেছে, তারা বইটা পড়েছে, এবং সত্য ও অকাট্য যুক্তির শক্তি এমনই যে তারা ভয় পেয়ে গেছে যে, পাছে না আবার তাদের পাঠকগোষ্ঠী হাতছাড়া হয়ে যায়, ব্যবসা পড়ে যায় এবং আমার স্রষ্টাভাবনা বইটি সেই স্থান দখল করে। সেই ভয় থেকে এদেরই কোনো এক লোক আমার বিরুদ্ধে সত্যমিথ্যা মিশিয়ে রাতারাতি গোয়েন্দা রিপোর্ট তৈরি করে নোট পাবলিশ করে -- এবং নিজেদের ভক্তবৃন্দের মাঝে সেটা প্রচার করে। এবং সতর্ক করে দেয়, যেন “জবাব দেবার উদ্দেশ্যেও নূরে আলমের স্রষ্টাভাবনা বইটি কেউ না পড়ে”, কেননা বিরোধিতা (তথা যুক্তিখণ্ডন) করতে এসে নাকি বই পড়ে মানুষ বিভ্রান্ত (!) (নাকি সত্যপ্রাপ্ত!) হয়ে যেতে পারে। অপর মুসলিমের যুক্তি/বক্তব্য এই সালাফিরা শুনতে পারে না, কিন্তু নাস্তিকদের সাথে যুক্তির ময়দানে আর্গুমেন্ট করে -- কী এক ডাবল স্ট্যান্ডার্ড!

আরো আশ্চর্য বিষয় হলো, সেই নোট লেখককে আমি চিনি না, তবু আমাকে সে আগেই ব্লক দিয়ে রেখেছিল যেন আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে না পারি। তারপর সেই নোট তাদের ‘ইসলামী ফেইসবুক সেলেব্রিটিরা’ ব্যাপক প্রচার করল। আরও দেখলাম, আমার সাথে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্র ধরে পরিচিত এক জুনিয়র সেখানে “উনি শীর্ষ জামায়াত নেতার নাতি, উনার বাবা-মা রেডিও তেহরানের সাংবাদিক ছিল” ইত্যাদি তথ্য দিয়ে মহান এক কাজ করে ফেলেছে। এদিকে আমি এসবের কিছুই জানি না, বইয়ের ব্যস্ততা শেষ করে এস্তোনিয়া ফেরত যাবার প্রস্তুতি নিতে তখন ব্যস্ত আমি।

আমিতো আর ফেইসবুক সেলেব্রিটি হতেও আসিনি, আর ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে লেখা বই বেচে খাওয়ার মত নোংরা দারিদ্রও আল্লাহ আমাকে দেননি। আমি কোনো এক ব্যক্তির অনুরোধে একটি বই লিখেছিলাম, কিন্তু সেখানের হুসাইনী সত্য বাঙালি সালাফি এস্টাবলিশমেন্টের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি আমি অনলাইনে অনেকটাই ইনঅ্যাক্টিভ -- তবু খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামের এই শত্রুদের ভয় কমে না। আমার মুখ তো তারা বন্ধ করতে চায়ই, সেইসাথে আমার সাথে সম্পর্কিত সবাইকে ও সবকিছুকে এতটাই ভয় পায় যে, মাথা খারাপ হয়ে গিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়ে লিখেছে: “উনার নাতি শিয়া, উনার পরিবার আহলে সুন্নাহ, এটা অবিশ্বাস্য।” আমি কেবল এটুকু বললাম যে,
“নাতির বৈশিষ্ট্য নানা পেয়েছে, কিংবা ছেলের বৈশিষ্ট্য তার বাপ পেয়েছে -- এমনটা কখনো শুনিনি। অতএব, "নাতি শিয়া বলে উনার পরিবারও শিয়া হয়ে যাবে" -- এমন ধারণা করাটা নিতান্তই logical anomaly সম্পন্ন মস্তিষ্কের কাজ। বরং শুনেছি এই অঞ্চলে বাপের ধর্ম ছেলে পায়, নানার ধর্ম নাতি পায়। বাড়তে বাড়তে আপনাদের হয়ত সেটা ধর্ম পেরিয়ে 'মাযহাব' পর্যন্ত পৌঁছেছে।
আমার তা নেই।
নূর হোসেন মজিদীর তা নেই।
মাওলানা আবদুস সুবহানেরও তা ছিল না।
আমরা পড়াশুনা করেছি, চিন্তা করেছি, এবং নিজের পথ নিজে নির্বাচন করেছি। সেপথে চলেছি, চলছি, এবং চলব ইনশাআল্লাহ: পারস্পরিক ভিন্নতা সত্ত্বেও সম্মানসহ সহাবস্থান -- কেননা এ অবস্থানগুলো পৈত্রিকসূত্রে আসেনি, জ্ঞান চর্চার সূত্রে এসেছে।”

এর বাইরেও শিয়া ও অ্যান্টি শিয়া উভয় গ্রুপ থেকেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি: “মওলানা আবদুস সুবহান কি শিয়া ছিলেন / হয়েছিলেন?”

আসলে, ক্ষুদ্রচিন্তা ও ক্ষুদ্র গণ্ডির মানুষদের সাথে চলে তাদের উপকার করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। একমাত্রিক ব্যক্তিত্বের মানুষেরা কখনোই বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের লোকেদেরকে বুঝতে সক্ষম নয়। ১৯৭১ সালে নানাজী যখন হিন্দুদেরকেও আইডি কার্ড দিলেন, এবং পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক গ্রেফতারকৃত হিন্দুদেরকে ছাড়িয়ে আনার জন্য আর্মির কাছে গেলেন, তখন আর্মি বলল, “আপনি এই কাফেরদের জন্য সুপারিশ করতে এসেছেন কেন?”
নানাজী বললেন, “কাফের বলেন আর মুসলমান বলেন, সবাই তো মানুষ। মানুষের জন্য আমি এসেছি। তারা অন্যায় করে নাই, সুতরাং তাদেরকে আপনি মারতে পারেন না। ইসলামে যুদ্ধক্ষেত্রেও যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নাই তাদেরকে মারধোর করা কিংবা সম্পদ লুণ্ঠন করা কিংবা মান-ইজ্জত হরণ করা শরীয়তেও জায়েজ নাই।” এই বলে নানাজী তাদেরকে মুক্ত করে আনেন। হিন্দুদের জন্য নিজ বাড়িতে লঙ্গরখানা খুলেছিলেন, সেখানে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল -- আমার মনে হয় আজকের এই কূপমণ্ডুক সালাফিরা হয়ত এখন হিসেব করতে বসবে যে, ‘মূর্তিপূজারীদের’ জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করাটা হারাম নাকি মাকরুহ!

ইমাম খোমেনী (র.) যখন নির্বাসন জীবনের শেষ তিনমাস ফ্রান্সে ছিলেন, তখন ক্রিসমাসের দিনে খ্রিষ্টান পরিবারগুলোকে মিষ্টি ও শুভেচ্ছাবার্তা পাঠালেন -- তাই দেখেও কূপমণ্ডুকেরা নানাধরণের কথা বলল। ইমাম খোমেনীর (র.) বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বকে বুঝতে গিয়ে গবেষকরাও হিমশিম খায় যে, কিছু গান-বাজনা ও দাবা খেলাকে জায়েজ ফতোয়া দেয়া ‘উদারপন্থী’ এই আলেম কিভাবে সালমান রুশদিকে মৃত্যুদণ্ড দেবার মত কট্টরপন্থী কাজ করতে পারেন!

মূলতঃ একমাত্রিক ব্যক্তিত্বের মানুষেরা বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের মানুষদেরকে বুঝতে পারে না। তারা কেবলমাত্র একটি বিষয় দিয়ে বিচার করতে সক্ষম, এবং তা কখনোই ন্যায়বিচার হয় না। আমার এই প্রায় ত্রিশ বছরের জীবনে আমি বহু মানুষের সাথে ধর্মীয়-রাজনৈতিক-সামাজিক বিষয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক করার পরে এটাই বুঝতে পেরেছি যে, সমস্যাটা মাত্রাগত। অতএব, মানুষের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি না করে তার সাথে যুক্তিতর্ক চালিয়ে যাওয়াটা বোকামী।

*** *** *** *** *** *** *** ***

নানাজীর সুবিশাল কর্মময় জীবন। আলহামদুলিল্লাহ, একেবারে সফল জীবন। তাঁকে নানারকম দুঃখ-কষ্ট ও জুলুমের মুখোমুখি হতে হয়েছে তা সত্য, তবে তাঁর গোটা জীবনের যে সাফল্য, সেই সাফল্য সকল দুঃখ-কষ্ট ও ব্যথাকে ছাপিয়ে গেছে। পোস্টমর্টেম ও গোসলের পর ফ্রিজিং গাড়ির ভিতরে নানাজীকে যেভাবে দেখেছি, তারচেয়ে বেশি চোখে ভাসে পূর্ণ প্রশান্তিতে ঘুমন্ত তার চেই চেহারাটা, যেখানে আতর দিয়ে চুমু দিয়ে এসেছি আমি আগেরদিনই। আলহামদুলিল্লাহ! এত সুন্দর চেহারা! এ কেবল অনুভবই করা চলে।

আমার নানার অনেক বড় রাজনৈতিক পরিচয় আছে। ধর্মীয় জগতেও তিনি অনেক বড় নাম। বিশেষ করে বাংলাদেশের ইসলামিক মুভমেন্টের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে আছেন মওলানা আবদুস সুবহান, মওলানা আবদুর রহীম আর আমার আব্বু। সে ইতিহাস হয়ত আপনারা আব্বুর বইয়ে জানতে পারবেন (“মওলানা আবদুর রহীম (র.): একটি বিপ্লবী জীবন”)। নানাজী তাঁর পরিবেশ-প্রেক্ষাপট বিচারে ইসলামের খেদমত একভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন, সেটাই তাঁর পরিচয় রচে গেছে। আব্বু তাঁর পরিবেশ-প্রেক্ষাপট অনুযায়ী অসংখ্য লেখা ও চিন্তা দ্বারা দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। আর তাঁদের এই সাফল্যের অর্ধেকটার অংশীদার তাঁদের স্ত্রীগণ: আমার নানী আর আমার আম্মু। তাঁদের জীবন আলহামদুলিল্লাহ সফলভাবেই যাপন হয়ে গেছে। দুনিয়ার জীবন কর্মীর জীবন -- নষ্ট করবার মত সময় নেই -- আমার পরিবেশ-প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আমার পরিচয় আমাকেই রচনা করে নিতে হবে: সে পরিচয় মানুষ জানুক বা না জানুক, খোদার কাছে যেন অন্ততঃ সুন্দর হয়, সেই দোয়াই চাই।

আসসালামু আলাইকুম ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সালিহিন।

নূরে আলম
ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২০

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা