সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

~~ কৈফিয়ত ~~



বিয়ে করেছি আজকে দুই সপ্তাহ হলো। এই নিয়ে আমাকে গত দুইটা মাস ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। না, অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে নয়। বরং ব্যস্ত থাকতে হয়েছে একটা নতুন বাসা খোঁজা আর সেই বাসার জন্য ন্যুনতম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। কেননা আমার মা চাননি যে আমি তার বাসায় আমার বউ নিয়ে থাকি। কারণ এই মুহুর্তে আমি বিয়ে করি সেটা তিনি চাননি। এছাড়াও, প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের স্বাধীনতা আছে।

বিয়ে নিয়ে আমার মায়ের সাথে আমার কথা হয়েছে তিন মিনিট। আমি বলেছিলাম, ওমুকের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেন।
আম্মু বলল, করোগে যাকে খুশি বিয়ে। বিয়ে করে চলে যাও। আমি বাধা দেব না।
বললাম, বাধা দেবার এখতিয়ার তো আপনার নেই। না সেক্যুলার ল'তে আছে, আর না ইসলামিক ল'তে আছে। আপনি কেবল সামাজিকতায় উপস্থিত হবেন, এটুকুই। আর সেটা যদি আপনি যেতে না চান, আপনার ব্যক্তি স্বাধীনতা। এটা আমার কোনো অধিকারও না যে আমি তা দাবী করব।

এরপর বহু লোকে আমাকে বহু দিন ধরে 'বুঝিয়েছে' যে, "তোমার মাকে একটু বুঝাও, মা তো, অবশ্যই বুঝবে।" আমি তাদের আবেগটাকে মর্যাদা সহকারে গ্রহণ করেছি, কিন্তু আমি আমার মাকে চিনি, কেননা আমি তার শরীরেরই অংশ। প্রচণ্ডরকম ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অধিকারী ও চর্চাকারী আমাদের পরিবারের সবাই। আর সেটা আমার বাবা-মায়ের থেকেই এসেছে। আমার (তখন) হবু স্ত্রী "একটু বুঝাও, মা-তো, রাজি হবেন" বললে তাকে বলেছি, তুমিতো আমার মাকে বিয়ে করবে না, বিয়ে করবে আমাকে। তার রাজি হওয়া না হওয়ার প্রশ্ন আসছে কিভাবে? বিয়ে করবে আমাকে, আমি রাজি হয়েছি, ব্যস।

আর আব্বুর সাথে বিয়ে নিয়ে কথা হয়েছে দুই মিনিট। অফিস শুরুর দশ মিনিট আগে একটু দেখা হলে আব্বুকে বললাম, আমিতো ওমুককে বিয়ে করার কথা ভেবেছি। তা ওদের ফ্যামিলি একটু আপনার সাথে দেখা করতে চায়। আপনি যেতে পারবেন কিনা কোনো উইকএন্ডে?
আব্বু বলেছে, হ্যাঁ, কোনো অসুবিধা নাই। আমি সবসময়ই নীতিগতভাবে মনে করি ছেলেমেয়েরা অ্যাডাল্ট হলেই তাদের বিয়ে দেয়া উচিত এবং তাদের বিয়ের অধিকার আছে...।
বললাম, আর আম্মুতো চাইছে না, তাই এদিকেই আরেকটা ছোট দেখে বাসা নিয়েছি।
আব্বু বলল, হাঁ ঠিকই আছে। এমনিতেও ইসলাম অনুযায়ী ছেলেমেয়ে বিয়ে করলে আলাদা থাকাই উচিত।

তারপর আমি নতুন বাসা ভাড়া নেয়া থেকে শুরু করে বাসার প্রয়োজনীয় ৮০টি জিনিসপত্রের তালিকা করে সেগুলি কিনে বাসা রেডি করে এক মাসের মাথায় বিয়ে করে বউ ঘরে এনেছি। এবং সেটা করতে হয়েছে কোনো ছুটি না নিয়ে সপ্তাহে পাঁচদিন করে অফিস করেই। আমার অতি ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সহায়তায় এত কম সময়ে এগুলো করা সম্ভবপর হয়েছে।

১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ আরবি মহররম মাসে পড়েছে। মহররম মাসে বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না, তবু নানা কারণে করতে হয়েছে, বিশেশতঃ সেজাপু ছুটি শেষে তুরস্কে ফিরে যাবে, সেটা বিবেচনা করে। যাহোক, আমি যে বিয়ে করেছি তা বুঝাতে বিয়ের একটা ছবি ফেইসবুকে দিলাম দুদিন পর। খুবই স্বাভাবিক যে অনেকে মনে করে থাকবেন, এত আয়োজন-অনুষ্ঠান সাজগোজ করে বিয়ে করেছে মাসুদ / মাসুদ ভাই, কোনো দাওয়াত দিলো না! জানালোও না!

না, আমি খেজুর-বিয়ে পন্থী লোক নই। বাড়িতে মেহমান আসলে মুরগি রেঁধে খাওয়াব আর বিয়ের দিনে খাওয়াব খেজুর? আমি তেমন লোক নই।
হ্যাঁ, আমার পক্ষে সম্ভব হলে চেনা-অচেনা সবাইকে ফেইসবুকে-ফোনে দাওয়াত দিয়ে একটা অনুষ্ঠান করতাম। মানুষজন একত্রিত হয়ে খাওয়া দাওয়া করায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু নতুন বাসা নিয়ে তার খরচ বহন করতে গিয়ে আমার সীমিত সামর্থ্য ফুরিয়ে গেছে, একারণে আমি কোনো অনুষ্ঠানই করিনি! কেবল পরিবারের দুই-দশজনকে সাথে নিয়ে মেয়েপক্ষের অনুষ্ঠানে গিয়ে বিয়ে করে বউ তুলে এনেছি।

বিয়ের পরে আমি তাকে বলেছি, দেখো, তুমি কখনো আমাকে সন্তুষ্ট করাকে তোমার টার্গেট বানিয়ো না, কারণ আমার পছন্দ-চাওয়া-পাওয়া সবসময় একই থাকবে না, এবং তার শেষও থাকবে না; আর আমিও তোমাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতে থাকলে কোনোদিন থামতে পারব না --- বরং তুমিও ইসলামটাকে মেনে চলার চেষ্টা কোরো, আমিও মেনে চলার চেষ্টা করব -- আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলে দেখবে তিনি আমাদেরকে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জায়গায় এনে দিয়েছেন।

তারপর আমার স্ত্রী আমার 'দরবার' অর্থাৎ এত গেস্ট আসা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। আমি বলেছি, তোমাকে না শ্বাশুড়ির কিচেনে গাদা গাদা লোকের খাবার রান্না করতে হয়, না এখানে রান্না করতে হয়: আমিই রান্না করছি, আর না ঘর ঝাড়ু দিতে হয়, আর না নিজের কাপড়টা হাতে ধুতে হয়, স্বামীর কাপড় ধোয়া তো দূরের কথা। তবুও, রেসিডেন্স যেহেতু তোমার অধিকার -- এগুলো যে আমি তোমাকে বিশেষ ফেভার করছি তা না, এগুলো তোমার অধিকারের মধ্য থেকেই -- যেহেতু তোমার অধিকার, সেটা যখন তুমি একভাবে ক্লেইম করেছ, আমি সেটা সেভাবেই দেব।

তারপর আমি আমার দরবারকে আরেক জায়গায় নিয়ে গিয়েছি। তাতে হয়ত আমার বেশকিচু খরচ বেড়েছে, তাতে কী, তারচে আরো বেশি খরচতো গিয়েছে আর যাচ্ছে আব্বু-আম্মুর বিশাল বড় ফাঁকা বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় বউ নিয়ে থাকতে গিয়ে। কিন্তু এতে না আমি আমার বউয়ের উপর অসন্তুষ্ট, আর না আমি আমার মায়ের উপর অসন্তুষ্ট, আর না এতে তাদের সাথে আমার সম্পর্কে ব্যাসকম হয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই নিজেদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও অধিকারের ভিতরে থেকেই কথা বলেছে। আর এগুলো ইসলাম-প্রদত্ত অধিকারের সীমারেখার ভিতরেই ঘটেছে।
আমি আমার বউকে বলেছি, আমি তোমাকে সারাজীবন রান্না করে খাওযাতে পারব, তবে তুমিও ইসলামটা মেনে চলার চেষ্টা কোরো। 'সংসার' বলতে বাঙালি নারী যা বোঝে, তার সব কাজ থেকেই আমি তাকে মুক্ত করে দিয়েছি, কেননা ইসলাম স্ত্রীকে সেসব দায়িত্ব দেয়নি। But that is a very high bet to place -- এপাশ থেকে আমি ভেতো বাঙালি স্বামী হওয়া থেকে বেরিয়ে আসলে তার দিক থেকেও ট্র্যাডিশনাল বাঙালি স্ত্রী হওয়া থেকে বেরিয়ে আসার অবলিগেশান তৈরি হয়ে যায়। যদিও এটা অনেক বড় বাজি -- কিন্তু খোদামুখী লক্ষ্যবিহীন মৃত জীবন আমি চাই না।

কেউ যদি বলেন, প্রথম প্রথম অমন রান্না করে খাওয়ানোই যায় -- তবে আমি বলব, আমি তর্ক করতে আসিনি। আমি গল্প বলতে এসেছি: পরিচিতজনদের প্রতি ভালোবাসার একটা দায় আছে, সে দায় থেকে ব্যস্ততার কৈফিয়ত দিতে এসেছি। আর আমি যদি ভবিষতে ইসলাম-প্রদত্ত স্বামী-স্ত্রীর অধিকার-কর্তব্য মেনে চলতে না পারি, তবে সেই ব্যর্থ আমার জন্য দোয়া করবেন, কিন্তু তাকে দিয়ে নিজের ব্যর্থতাকে জাস্টিফাই করবেন না: খোদার দরবারে তা গৃহীত হয় না।

এইতো! কথাগুলো বেশ ভারী শোনালেও, সবমিলিয়ে আমি ভালোই আছি। প্রাথমিক ব্যস্ততা শেষ করে এইযে আবার লিখছি! অফিস করি, দরবার করি, তারপর বউকে লেকচার দিতে থাকি এবং এক পর্যায়ে সে ঘুমিয়ে যায়! 

আর হ্যাঁ, আমার বিবাহিত (হেহে) বাসায় সকলের দাওয়াত। পাকিস্তানি শান বিরিয়ানি মশলা দিয়ে একদম খাঁটি বিরিয়ানি রেঁধে খাওয়াব। গরম লাগলে থাকবে পাকিস্তানী জিএফসি ফ্যানের হাওয়া ;) আর দরবার তো সবার জন্য সদা উন্মুক্ত। এখন আরো উন্নত, দ্বিগুণ শক্তিশালী, new and improved! 
… … … … … 
আরো কিছু কথা বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তা কখনোই বলা হবে না। আমাদের মুসলিম উম্মাহর এই গাফিলতির জীবন এভাবেই চলতে থাকবে কেয়ামত-তক।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা