সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অশ্রুপাতের বেলা শেষ

সালাম।
বাংলাদেশে এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ -- এমন নিউজ আমরা পেয়েছি। ওদিকে মুক্তিপণ না পেয়ে সাত বছরে বাচ্চাকে হত্যা করেছে মসজিদের 'ইমাম' সাহেব। এছাড়াও মাদ্রাসাগুলোতে বাচ্চাদেরকে নির্মভাবে পিটানো হয়, এবং এতে মৃত্যুর ঘটনা কিছুদিন আগেও ঘটেছে, সেসব সংবাদও আপনারা কমবেশি অনলাইনে দেখেছেন।

নুসরাতের শাহাদাতে সবাই ব্যথিত, ক্ষুব্ধ এবং দিশাহারা ও অসহায় বোধ করছেন। মাদ্রাসা ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ফাইনালি বহু লোকে ভাবতে শুরু করেছেন। আমি দুটো কথা বলতে চাই।

১. দোষারোপে কোনো সমাধান হয় না।
অবশ্যই দোষীকে শনাক্ত ও দণ্ড দেয়া জরুরি। কিন্তু একইসাথে আরো বেশি জরুরি হলো দোষের কারণ খুঁজে বের করা এবং 'রোগের গোড়া মেরে সমাধান' করা। ফেইসবুকসহ টিভি-পত্র-পত্রিকা ইত্যাদি মিডিয়াতে বিভিন্ন ঘটনা দেখে আমরা 'ওমুকরা দোষী', 'ওমুকরা দায়ী' এটা বের করি বটে, কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপ, যা হলো অপরাধীর দণ্ড কার্যকর করা -- তা দুঃখজনকভাবে আমাদের হাতে নেই; আর যাদের হাতে আছে, তারা নিজেরাই করাপ্টেড। মাছের মাথা পচে গেলে দেহেও পচন ধরে: জালিম সরকার দীর্ঘদিন থাকলে জনগণও জালিম হয়ে ওঠে: নৌকার আগা যেদিকে যায়, পাছাও সেদিকেই যায়। অতএব, একটি ন্যায়পরায়ন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চিন্তা-গবেষণা করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ, সমস্যার গোড়া নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে হবে যে: ইসলামের ধারক বাহক 'হুজুরদের' ভিতর থেকে কিভাবে এমন ঘটনা ঘটছে। আর সে প্রসঙ্গেই আমার দ্বিতীয় পয়েন্ট:

২. একজন টিনএজার তার বন্ধুর সাথে খারাপ আচরণ করছে, আরেকজন পোষা বিড়ালকে লাথি মারছে, আরেকজন ফোন আছাড় দিচ্ছে, আরেকজন সুইসাইড করেছে -- হতে পারে যে, এই চারটি ঘটনারই গোড়া একটা: বাবা কিংবা মা বকেছে।
অধিকাংশ মানুষ সারফেস (surface- উপরের অংশ) দেখে শুধু। তখন তারা ভাবে, সমাজে চারটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে/ চারটি অন্যায় ঘটেছে।
কিন্তু একজন চিন্তাশীল গবেষক প্রতিটা ঘটনার গোড়া অনুসন্ধান করে দেখেন যে, মাত্র একটি সমস্যার সমাধান করলেই বাকিগুলো অটোমেটিক ঠিক হয়ে যাবে।

ফেইসবুক খুললেই বাংলাদেশের অসংখ্য অন্যায় অনাচারের ঘটনা দেখে আপনি যেন অস্থির ও দিশাহারা হয়ে পড়বেন না। কারণ আপনি দেখছেন সমাজের প্রতিটি সেক্টরে সমস্যা, হাজারটা ইস্যু; কিন্তু আমরা হয়ত দেখছি দুই একটা ইস্যু: রোগের গোড়া।

আমি আপনাদেরকে প্রশ্ন করতে চাই: আত্মীয়-স্বজন মরলে যেই হুজুরদেরকে বুকে জড়িয়ে আমরা একটু শান্তির আশ্রয় পাই, যেই হুজুরদের কণ্ঠে তেলাওয়াত শুনে পাপী হৃদয় অশ্রুপাতে বোঝা লাঘব করে -- সেই হুজুর কিভাবে নিজে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করে? কিভাবে তার হৃদয় আরো বেশি পাষাণ হয়ে ওঠে?
আপনারা রিসার্চ করুন, গবেষণা করুন। আমাকে তথ্য এনে দিন: আলেমসমাজ কর্তৃক এত বেশি যৌন নিপীড়ন, অন্যায় হত্যাকাণ্ড, ধর্মশিক্ষার ছাত্রদেরকে বেধড়ক পিটুনি, পিটিয়ে হত্যা, আগুনে হত্যা, শ্বাসরোধে হত্যা -- ইত্যাদি বিগত ১৪০০ বছরের মুসলিম জাতির ইতিহাসে কবে ঘটেছে? আদৌ ঘটেছে কি? ঘটে থাকলে কেন? কাদের শাসনামলে? কোন ধারার ধর্মচর্চাকারী ছিল তারা? আর আজকে বাংলাদেশে যারা এসব করছে, তারা কোন ধারার ধর্মচর্চাকারী?

এগুলোই হলো গবেষণা, রিসার্চওয়ার্ক। একটি টেকসই শান্তিপূর্ণ সমাজ পেতে হলে কেবল একে অপরকে দোষারোপ আর চোখের জল ঝরানো যথেষ্ট নয়, ব্রেইনের নিউরনগুলোকেও খুব খাটাতে হবে সেজন্যে। যে জাতির অশ্রুপাতের পেছনে দৃঢ় বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি থাকে না, তাদেরকে আজীবন কেঁদেই যেতে হবে।

১৪০০ বছর যাবত মুসলমানদের মাঝে আলেমসমাজ ছিল, আছে। আপনি-আমি টিভির রিমোট হাতে খেলা দেখতে দেখতেই কবে যে আমাদের ইসলাম ও আমাদের আলেমসমাজ শয়তানের কাছে বর্গা দেয়া হয়ে গেছে, তা আমরা খেয়াল করিনি। এখন আগুনের আঁচ আমাদের খুব কাছে চলে এসেছে। আশা করি এখন সবাই সমাজ ধর্ম রাষ্ট্র অর্থনীতি ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবেন এবং ১,০০০টা সমস্যার এমন ১০টা গোড়া খুঁজে বের করবেন, যে দশটি দিক ঠিক করতে পারলেই আর কোনো ছাত্রীকে মাদ্রাসার ভিতরে আগুনে পুড়তে হবে না।

আমি আমার মত করে চিন্তা-গবেষণা করে যাচ্ছি এবং কোন ধারার ইসলাম চর্চা যে আমাদেরকে আজকের এই দুঃখজনক অবস্থায় উপনীত করেছে, তা দেখতে পাচ্ছি। একইসাথে খাঁটি ইসলামের প্রচার-প্রসারকে একবিন্দু হলেও সহায়তা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তাতে হয়ত কেউ কেউ "আরেক নুসরাতের হত্যাকারী" হওয়া থেকে বেঁচে যাচ্ছে; বেঁচে যাচ্ছে আরো কোনো নুসরাত, বেঁচে যাচ্ছে আরো কোনো 'হুজুর' -- কিন্তু সেটা কারো জানার উপায় নেই।

কারণ মানুষ মরলে সবাই লক্ষ্য করে, বেঁচে থাকলে লক্ষ্য করে না। আপনারা মানুষকে বাঁচান। আমি কিন্তু একজন দুইজন করে হলেও 'মানুষ' বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। একসময় মৃত্যুর দর্শক ছিলাম, এখন মানুষ বাঁচানোর কর্মী হয়েছি। কিন্তু ঐযে: কোনো মানুষ আরেকটা দিনের জন্য বেঁচে গেলে সেটা কেউ লক্ষ্য করে না, সেটা নিয়ে নিউজ হয় না। কিন্তু আমি এমন বহু কর্মী দেখেছি: যারা নীরবে মানুষ বাঁচানোর কাজে নিয়োজিত। আমার দেখা সেইসব মহামানবেরা যদি আজকে পৃথিবীতে না থাকতেন, তাহলে ফেইসবুকে প্রতিদিন হাজারটা নুসরাতের লাশের ছবি দেখতে হতো।

নিজেকে প্রশ্ন করুন: আপনি নুসরাতের মৃত্যুর দর্শক, নাকি আরো অন্ততঃ একজন নুসরাতকে বাঁচানোর কর্মী? সেটা পেট্রোল ঢালার আগমুহুর্তে সন্ত্রাসীদেরকে হাত দিয়ে ঠেকিয়েই হোক, কিংবা খাঁটি ইসলাম মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়ে কাউকে সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েই হোক।

আশা করি আমরা সকলেই 'মৃত্যুর নীরব দর্শক' থেকে বদলে 'জীবন বাঁচানোর সক্রিয় কর্মী' হব।
অশ্রুপাতের বেলা শেষ।

নূরে আলম
এপ্রিল ১১, ২০১৯

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা