সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জীবনের বিনিময়

আমার কলেজের এক বান্ধবী-- প্রথমবার যখন আমাদের বাসায় আসলো, তখন সেজাপুর কাছে হাত দেখিয়েছিল।
আমরা সব ভাইবোনই তখন কমবেশি জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করি, তার মাঝে সেজাপু সবচে' ভালো পারত। তার হাত দেখে সেজাপু এমন কিছু বিষয় প্রকাশ করে দিল, যা তার ভালো লাগেনি। তারপর থেকে কলেজে আমি যখনই কারো হাত দেখতাম কিংবা সংখ্যাতত্ত্বের আলোচনা করতাম, আমার সেই বান্ধবীটি আগ বাড়িয়ে খুব করে বিরোধিতা করত।
কী অদ্ভুত সাইকোলজি! অথচ এই জ্যোতিষবিদ্যার প্রতি সে-ও মুগ্ধ ছিল, এবং এটা যে একটা খাঁটি বিদ্যা, তা বুঝত। সেসময় আমি বেশ চর্চার মধ্যে ছিলাম, কারো সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলেই অনেকসময় জন্মতারিখ বলে দিতে পারতাম, কিংবা জন্মমাস। এসব সে দেখেছে, জানত। তবুও, ঐদিনের পর থেকে খুব করে বিরোধিতা করত, জ্যোতিষবিদ্যাকে ভুয়া প্রমাণের চেষ্টা করত। কী অদ্ভুত!

নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্য সেই যুগ থেকে আজকে পর্যন্ত কোটি কোটি নারী-পুরুষ জান-কোরবান, অথচ সেই মুহাম্মদ (সা.)-কেই তাঁর স্ত্রীদের কেউ কেউ যতটা না নবী হিসেবে দেখেছিলেন, তার চেয়ে বেশি দেখেছিলেন 'আমার স্বামী' -- এই হিসেবে। যেকারণে পারস্পরিক ঈর্ষা-বিদ্বেষ, কুটনামী, নবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করলেন এমন পর্যায়ে যে, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কুরআনে তাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিলেন, এবং বলে দিলেন যে, তারা যদি এধরণের আচরণ কন্টিনিউ করে, তাহলে আল্লাহ তাঁর হাবীবকে অধিকতর উত্তম স্ত্রী দান করবেন। কিন্তু নবীজির (সা.) দয়ার শরীর। তিনিই বরং নিজেকে কষ্ট দিয়ে হলেও সবকিছু ঠিক রাখার চেষ্টা করলেন। রাহমাতুললিল আলামিন বলে কথা।
কিন্তু -- স্বয়ং নবীকে পেয়েও তাকে টেনে নিচে নামিয়ে 'আমার স্বামী' বানানোর এই সাইকোলজি -- কী অদ্ভুত!

পৃথিবীতে খোদাবিমুখ মানুষকে খুব ভয় করবেন। কেননা, তারা তাদের দুনিয়াবী চাহিদা পূরণের জন্য যে কাউকে ব্যবহার করে নিঃশেষ করতে দ্বিধা করে না;  এমনকি সাধু-সন্ন্যাসীকেও। মানুষের নাফসানিয়াত বা প্রবৃত্তি এমনই জিনিস। ক্ষণস্থায়ী সুখের জন্য অটল পাহাড়কে ধ্বসিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। অতএব, দুনিয়াপূজারী ও প্রবৃত্তির দাস মানুষদেরকে খুব ভয় করবেন; তাদের সাথে এমনভাবে মিশবেন না, যাতে তারা আপনাকে নিঃশেষ করে দিতে পারে!
ইউসুফ (আ.)-- একজন নবী -- নিষ্কলুষ পবিত্র জীবন তাঁর দীর্ঘদিনের গড়ে তোলা অটল পাহাড়, অর্জন। সাময়িক জৈবিক সুখ পেতে সেই অটল পাহাড়কে ধ্বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে ছাড়েনি এক নারী। কেবলমাত্র তার কিছু মুহুর্তের জৈবিক সুখ -- সেজন্যে একজন নবীকে পর্যন্ত নরকে পাঠাতে, পয়সার মত খরচ করতে রাজি সে -- কী অদ্ভুত!

আমরা সাধারণ মানুষেরা কেউ-ই শতভাগ খোদাবিমুখ নই, আবার শতভাগ খোদামুখীও নই। আপনিই ভালো বুঝবেন, আপনি কতটা খোদামুখী, আর কতটা প্রবৃত্তির পুজারী। আপনিই ভালো বুঝবেন, আপনার ঘনিষ্ঠ মানুষটা কতটা প্রবৃত্তির পুজারী, আর সেজন্যে সে আপনাকে কতটা অকাতরে 'খরচ' করে ফেলতে পারে।
আর নিজে যদি তেমন হন, তাহলে নিজেকেও ভয় করুন। হয়ত আপনার সস্তা চাহিদা পূরণে আপনি এমন ব্যক্তিকে পয়সার মত খরচ করে ফেলছেন, যার মাঝে খোদায়ী নূর প্রতিফলিত হত!

এইযে কদর্য চাহিদা, এইযে প্রবৃত্তি -- তা যদি সরাসরি প্রকাশিত হতো, তাহলে খুব সম্ভবতঃ কেউ-ই এগুলোতে সাড়া দিত না। হুটহাট অপরিচিত মানুষ এসে যদি আপনাকে বলত, "আমি তোমার সাথে খাতির জমাব ধীরে ধীরে যেন তোমার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের সুবিধা পেতে পারি", কিংবা যদি বলত, "আমি তোমার সাথে সেক্স করতে চাই তাই ভালোবাসার কথা বলে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করতেছি" -- তখন বোধহয় আপনি ছিছি করতেন, এবং এক লাথিতে দূরে সরিয়ে দিতেন। তাই এগুলো কখনো সরাসরি উপস্থাপন করে না মানুষ, বরং তা করা হয় সুন্দর মোড়কে।
একটু চিন্তা করে বলুনতো, পৃথিবীর যত গান, যত সাহিত্য, শিল্প, মানুষের মানুষে সম্পর্ক, উপহার, আদান-প্রদান ইত্যাদি আরো যত যাকিছু আছে -- এর কতটার পিছনে খুব কদর্য চাহিদা লুকিয়ে থাকে?
সম্ভবতঃ, বেশিরভাগের পিছনেই।

অতএব, বন্ধু, স্বামী/স্ত্রী কিংবা সন্তান-- ইত্যাদি বিভিন্ন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন: ভালোবাসার মায়ার আড়ালে আপনি পয়সার মত খরচ হয়ে যাচ্ছেন নাতো? কিংবা, কাউকে পয়সার মত খরচ করে ফেলছেন নাতো?

যদি আপনার জীবনটা এমনভাবে খরচ হয় যে, তাতে আপনার স্ত্রী/ স্বামী/ সন্তান/ বন্ধু-বান্ধবেরা খোদামুখী হয়, তবে আপনার জীবনটা কাজের কাজে লেগেছে। আর যদি তা না হয়, যদি তাদের ক্ষণস্থায়ী চাহিদা পূরণের পিছনেই ব্যবহৃত হয়, তবে আফসোস! টিস্যু পেপারের মত খরচ হয়ে গেছেন। দিনশেষে খোদাতায়ালার সামনে না আপনার কোনো অবস্থান থাকবে, আর না থাকবে তাদের, যাদের মায়ায় পড়ে জীবনটা পয়সার মত খরচ করে দিয়েছিলেন!

খোদাপ্রাপ্তি ছাড়া আর কোনোকিছুই এই জীবনের বিনিময় হতে পারে না।

নূরে আলম
তালিন, এস্তোনিয়া
ডিসেম্বর ২৩, ২০১৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা