সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

লুকিয়ে রাখা মুসলিম ইতিহাস: ফাদাকের উদ্যান

রুক্ষ শুষ্ক মরু এলাকা জাজিরাতুল আরব। একেকটা পানির কূপ যেন স্বর্ণের খনি। প্রতিটা খেজুর গাছ, আঙ্গুর গাছ, ইত্যাদি অতি যত্নের সম্পদ। এমন দেশে ফলের বাগান থাকাটা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর এই সৌভাগ্যটা ছিল তৎকালীন ইহুদিদের। মদিনা থেকে ১৪০ কিলোমিটার মতন দূরে ফাদাক নামক জমিটা ছিল ইহুদিদের এক বিশাল সম্পদ; এই বাগানে ছিল প্রচুর খেজুর গাছ, আর অনেক পানির কূপ। একাধিক দূর্গ আর বাগান, শস্যক্ষেত মিলিয়ে ইহুদিরা উন্নত জীবন যাপন করত সেখানে। এলাকার নাম খাইবার।

নবুওয়্যাতের ১৩ বছর পর মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করে সেখানে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।এদিকে খাইবারের ইহুদিরাও তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। হিজরতের ৭ম বছরে তিনি খাইবার আক্রমণ করেন। একাধিক দূর্গ আর ফাদাকের মত বাগান আছে যেখানে।
ইহুদিদের সবগুলি দুর্গের পতন হলো মুসলিম বাহিনীর হাতে, কিন্তু কামুস দুর্গের কাছে এসে মুসলমানেরা কিছুতেই পেরে উঠছিল না। এটা ছিল ইহুদিদের সবচে শক্তিশালী দূর্গ। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরেও মুসলিম বাহিনী দূর্গ ভেদ করতে পারলো না। পতাকা নিয়ে হযরত আবু বকর গেলেন, ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন। হযরত ওমর গিয়ে আরো কঠোর আঘাত হানলেন। তবু দুর্গের নিরাপত্তা বূুহ্য ভেদ করতে পারলেন না, ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, "কাল সকালে আমি এমন একজনকে পাঠাবো, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসে; আল্লাহ ও তাঁর রাসুলও যাকে ভালোবাসেন।" পরদিন সকালে হযরত আলীর হাতে পতাকা দিয়ে রাসুল (সা.) পাঠালেন কামুস দূর্গ জয় করতে। দুর্গের যে দরজা তুলতে আটজন পুরুষের দরকার হতো, সেই দরজা এক হাতে তুলে নেন হযরত আলী। ইহুদীরা মুহাম্মদ (সা.) এর সাথে দেখা করে আত্মসমর্পন করলো এবং নিজেদের জমিতে থাকার অনুমতি পেল এই শর্তে যে, তাদের উৎপাদিত শস্যের অর্ধেক তারা মুসলমানদের দেবে। বিজয়ীর বেশে মুসলমানেরা মদীনায় ফিরল। পরবর্তীতে রাসুলুল্লাহ (সা.)  ফাদাকে দূত প্রেরণ করেন। খাইবারের মূল ভূখণ্ডে ইহুদী পরাজয় দেখে ফাদাকের লোকেরা বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পন করলো, এবং চুক্তির মাধ্যমে ফাদাক রাসুল (সা.) এর মালিকানাধীন হলো।

এই বাগান থেকে প্রচুর আয় হত। মুসলমানদেরকে শক্তিশালী করেছিলো এই ফাদাক। মুহাম্মদ (সা.) এর হাতকে শক্তিশালী করেছিল এই ফাদাক। ইসলামী রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করেছিল এই ফাদাক। অথচ এই বাগানের জন্য মুসলমানরা যুদ্ধ করেনি। যুদ্ধ ছাড়াই এ সম্পদ তাদের হস্তগত হয়েছিল (চুক্তির মাধ্যমে)।

আর এধরণের সম্পদের ব্যাপারে আল্লাহপাক বলেন:
"আল্লাহ তাদের কাছ থেকে তাঁর রাসুলকে যে সম্পদ দিয়েছেন সে জন্যে তোমরা ঘোড়ায় কিংবা উটে চড়ে যুদ্ধ করোনি, কিন্তু আল্লাহ যার উপর ইচ্ছা তাঁর রাসুলকে প্রাধান্য দান করেন। আল্লাহ সবকিছুর উপর শক্তিমান। আল্লাহ জনপদবাসীর কাছ থেকে তাঁর রাসুলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, তাঁর রাসুলের ও তাঁর আত্মীয় স্বজনের, ইয়াতিমদের, অভাবগ্রস্তদের ও মুসাফিরদের জন্য…।" (সূরা হাশর, ৬-৭)

অর্থাৎ, রাসুল (সা.) ও তাঁর আত্মীয়ের জন্য একটি অংশ থাকবে গণীমতের মাল থেকে; তা সেটা যুদ্ধ করেই পাওয়া হোক, কি যুদ্ধ ছাড়াই পাওয়া হোক (অন্যত্র যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ক্ষেত্রেও একইভাবে রাসুল (সা.) ও তাঁর আত্মীয়দের হক্ব দেয়া হয়েছে)।

এই বাগানটি রাসুল (সা.) তাঁর মেয়ে ফাতিমাকে উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। রাসুল (সা.) এর মৃত্যুর পর হযরত উমরের সমর্থনর হযরত আবু বকর মুসলমানদের খলিফা (শাসক) হন। খিলাফত পাবার সাথে সাথেই প্রথম তিনি যে কাজটি করেন তা হল, ফাদাকের বাগান কেড়ে নেয়া। তিনি রাষ্ট্রীয় বাহিনী পাঠিয়ে ফাদাক দখল করে নেন এবং সেখানের কর্মচারীদের বের করে দেন। মা ফাতিমা যখন আবু বকরের কাছে গিয়ে ফাদাক ফেরত চান, তখন তিনি উল্টা মা ফাতিমাকে ফাদাকের মালিকানার প্রমাণ হাজির করতে বলেন। হযরত আলী বললেন, এটা কেমন বিচার যে, যে জমি একজন দীর্ঘদিন ধরে ভোগ করছে, সেটা অন্য একজন এসে দখল করে নেবে, অথচ প্রমাণ হাজির করতে বলবে সে ব্যক্তিকে, যার জমি বেদখল করা হয়েছে?
বরং এটাই কি ন্যায়সঙ্গত নয় যে, যে ব্যক্তি এসে জবরদখল করেছে, সে-ই প্রমাণ হাজির করবে?

এই ফাদাক নিয়ে বহু বছর নানান ঘটনা ঘটতে থাকে। আবু বকর অন্যায়ভাবে ফাদাক কেড়ে নেবার পর মা ফাতেমা যে আর ছয় মাস বেঁচে ছিলেন, সে ছয় মাস তিনি আবু বকরের সাথে কথা বলেননি। তিনি বলেছিলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এ ঘটনার বিচার দেব। আমি তোমার উপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ফাতেমার সন্তুষ্টিতেই আমার সন্তুষ্টি, আর আমার সন্তুষ্টিতেই আল্লাহর সন্তুষ্টি। যে ফাতেমাকে সন্তুষ্ট করল সে আমাকে সন্তুষ্ট করল, আর যে আমাকে সন্তুষ্ট করল, সে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করল। আর যে ফাতেমাকে অসন্তুষ্ট করল, সে আমাকে অসন্তুষ্ট করল, আর যে আমাকে অসন্তুষ্ট করল,  সে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করল।

আপনারা অনেকেই হয়ত খায়বারের যুদ্ধের ঘটনা জানেন, এমনকি অনেকে হয়ত কামুস দূর্গ বিজয়ে হযরত আলীর বীরত্বের কথাও জানেন, কিন্তু জানেন না ফাদাকের বাগানকে কেন্দ্র করে রাসুলের পরিবারের উপর জুলুমের কাহিনী। মুসলমানদের হাতেই গোপন করে রাখা অসংখ্য মুসলিম ইতিহাসের মাঝে একটি হলো ফাদাকের এই বাগান।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা