আমার এখানে এখন রাত। জানালা দিয়ে তাকালে রাস্তা দেখা যায়। মাঝে মধ্যে দুই একটা গাড়ি যাচ্ছে, কিংবা লাক্স এক্সপ্রেস এর মত বড় বাস। সকাল হলেই গাড়ির সংখ্যা একটু বেড়ে যাবে, সেইসাথে বাইক, সাইকেল, ইত্যাদি। তবু খুব বেশি না। কোনো হর্ন শুনতে পাইনি আজ পর্যন্ত; এস্টোনিয়াতে এসেছি তিনদিন হলো।
আমার জানালা থেকে নদী দেখা যায়, দুই মিনিটের পথ। ছোট্ট নদী, কিন্তু এরা খুব সুন্দর করে বাঁধাই করে রেখেছে দুই পাড়। একটু পরপর পার্ক আর সেখানে বসার বেঞ্চি। পাথরের ফুটপাথ। রাস্তার দুইপাশে তো বটেই, এমনকি ছোট পায়েচলা পথগুলিতে পর্যন্ত স্ট্রিট লাইট। মায়াবী নিয়ন আলো। তাই দেখে ছোটবেলার কত স্মৃতি মনে পড়ে যায়! গভীর রাতে নিয়ন আলোয় আর দিনেরবেলা সূর্যের আলোয় এখানের রাস্তা, ফুটপাথ ইত্যাদি ছোটবেলার কিছু স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। কত্ত সুন্দর জায়গা!
এসব গল্প আর নতুন করে করার কী আছে? ইউরোপ আমেরিকার বহু দেশেই এমনটা আছে। সবকিছু পরিপাটি সুন্দর, গোছানো, নিয়মতান্ত্রিক। দুনিয়ার বহু দেশেই আছে। 'থাকার' জন্য খুব সুবিধাজনক আর আরামদায়ক। কিন্তু তাতে কী? Home is where heart is -- আমার মনে হয় কিছুদিন পরেই আমি আবার বাসায় ফিরে যাব, আমার রুমে গিয়ে আগের মত ব্যস্ত হয়ে পড়বো। (একইভাবে এটাও কি প্রতি মুহুর্তে অনুভব করা সম্ভব নয় যে আমি আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, কিছুদিন পর আবার তাঁর কাছেই ফিরে যাবো -- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন?)
আমি বড় হয়েছি বাংলাদেশে, এখন পড়াশুনার কাজে একটু বাইরে এসেছি, তবে সামনের দিনগুলো কোন দেশে কিভাবে কাটবে তা আমি জানি না। কিন্তু আমি নিজেকে মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছি বলে আমার মনে হয়। বাংলাদেশের মিরপুরেই অবস্থান করি, কি এস্তোনিয়ার তারতু সিটিতে -- আমার জগতটা আমার সাথেই আছে সবসময়। তাই এস্তোনিয়া আমার কাছে 'বিদেশ' নয়, বাংলাদেশও আমার কাছে 'দেশ' নয়; আমার দেশ হলো আমার হৃদয়ের জগত, আর যে মানুষদের হৃদয়ে আমি অবস্থান করি, আর সবকিছু শেষে আমি যেখানে ফিরে যাবো। এস্তোনিয়ায় এসেও আমার নামাজের পাটি আর তসবিহ একই আছে।
দেশে থাকা অবস্থায় আমাকে বেশকিছু কাজে নিষেধ করা হয়েছে; ঘনিষ্ঠজনেরা নিরাপত্তার আশঙ্কা করেছেন বলেই তা নিষেধ করেছেন। এসব নিষেধাজ্ঞা আমার স্বতঃস্ফূর্ততাকে ব্যহত করেছে। তখন আমি ভ্রু কুঁচকে কিবোর্ডে হাত রেখে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকি।
আমি একটা গল্প রচনা করছিলাম, এবং আমি তা করব। তা সেটা দুনিয়ার মানুষের অতি পরিচিত 'কেইস স্টাডি' ও 'স্ক্রিপ্টগুলোর' সাথে ম্যাচ হয় না মানেই এই নয় যে আমি ভুল করছি। দুনিয়ার মানুষ বালুকাবেলায় আঙুল দিয়ে গল্প লিখেছে, আমি পেন্সিল হয়ে রাস্তার উপর দাগ কেটে দিব -- কিন্তু আমার 'দেশ' যেখানে, সেই হৃদয়গুলি আমাকে সুন্দর-সুখী-নিরাপদ দেখতে চায়, তাই আমি এস্তোনিয়া চলে এসেছি। এই মাস্টার্স, এই পিএইচডি আমার নয়; আমি আমার পথ ছেড়ে দেইনি -- হয়ত আমি খোদার ইশারার অপেক্ষায় আছি। খোদায়ী ইশারায় প্রতি মুহুর্তে চারিদিকে অসংখ্য মিরাকল ঘটে যাচ্ছে -- আমি শুধু চোখ মেলে তা দেখবার চেষ্টা করছি। হয়ত কোনোদিন সেখান থেকে একটুখানি রঙ এনে সবাইকে রাঙিয়ে দিয়ে যাব।
দুঃখ একটাই, আমি যা দেখি, আমার ঘনিষ্ঠজনেরা তা দেখে না; আর তারা যা দেখে, আমি তা দেখি না। তবু ভালোবাসার দায়বদ্ধতা থেকে আমি আমার চলার পথকে যতটুকু পরিবর্তন করি, খোদা নিশ্চয়ই তা পছন্দ করেন, কেননা সেটাও ভালোবাসারই গল্প।
নূরে আলম
অগাস্ট ২২, ২০১৬, রাত চারটা বিশ।
অগাস্ট ২২, ২০১৬, রাত চারটা বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
[ব্লগে কমেন্ট পোস্ট করার পরও যদি না দেখায়, তাহলে দ্বিতীয়বার পোস্ট করার প্রয়োজন নেই। খুব সম্ভবত স্প্যাম গার্ড সেটাকে সরিয়ে নিয়েছে, আমি পাবলিশ করে দেবো।]