সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ছুটি



ছোটবেলায় আমার আনন্দের জায়গাগুলো ছিলো খুব সীমিত। একটা আইসক্রিম খেতে পারা, বেলুন কিনতে পারা কিংবা চিউয়িংগাম, অথবা কার্টুনের স্টিকার কেনা...। আর স্কুলের পর সারাদিন বাসায় অলস সময়ে বিভিন্ন ক্র্যাফটস বানানো ! এগুলো করতে করতেই আমি বড় হয়ে গেছি। তারপর… সেই আনন্দের জায়গাগুলি নিয়েই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। আমার সমবয়েসীরা প্রতি ক্লাস উপরে ওঠার সাথে সাথে আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে আনন্দের জায়গাগুলোকে বদলাতে লাগলো। সাধ্যের সবকিছুই স্পর্শ করলো তারা। কিন্তু আমি আমার নিজস্ব জগতেই রয়ে গেলাম। এমনি করে কিভাবে যেনো স্কুল পাশ করে ফেললাম, কলেজে ভর্তি হলাম।

এসময়েই জানি না কিভাবে আমার আনন্দের জায়গাটা হঠাৎ বদলে গেলো। কিন্তু সেটাও সমবয়েসী আর সবার সাথে মিললো না ! এখনও মেলে না। সবাই যখন নানা রকম খাওয়া-দাওয়া, দেশ-বিদেশ ঘোরা, গান-মুভি-আড্ডা-প্রেম ইত্যাদি ডাইভার্সিফাইড বিষয়ের মাঝে জীবনের আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে, তখন আমি এগুলোতে কোনো আগ্রহই পাই না। গুলশান ক্যাম্পাসে থাকতে প্রায়ই বিভিন্ন ফাস্টফুডে যাওয়া হতো, আর আমার কাছে যে বিষয়টা হাস্যকর লাগতো তা হলো, শুধু “খাওয়ার” উদ্দেশ্যে আমরা সবাই মিলে কোথাও যাচ্ছি। কিংবা খেতে খেতে সবার খাপছাড়া এলোমেলো কথার মাঝে যখন কিছুটা নীরবতা আসতো, তখন নিজেকে কল্পনা করতাম : বিশাল বড় এক বার্গার মুখের মধ্যে নিয়ে থুতনি নাড়িয়ে নাড়িয়ে চিবাচ্ছে। কেমন হাস্যকর লাগতো ! আর বন্ধু বান্ধবদের সাথে পথ হাঁটা, সেটা ভোর, ভর দুপুর কিংবা গভীর রাতেই হোক না কেনো, অথবা জগতের সুন্দর সব জায়গা দেখে বেড়ানো – এগুলোতেও আমি কোনো আগ্রহ পাইনি কখনো ! এখনো পাই না। আমি যখন স্কুল লাইফ পর্যন্ত ধরে রাখা নিজস্ব সন্তুষ্টির জগত থেকে বেরিয়ে আসলাম, তখন আমার সবচে' বেশি, এবং বলা যায় একমাত্র আনন্দ আর আগ্রহের জায়গা হলো মানুষ। আর মানুষকে জানার সর্বোত্তম উপায় হিসেবে জানতাম কথা বলাকে, তাই আমি কথা-নির্ভর মানুষ হলাম ! আমার আর কিছুই ভালো লাগতো না, ভালো লাগে না, শুধু নতুন মানুষকে জানা ছাড়া। সেজন্যে পাশাপাশি কিংবা মুখোমুখি বসে যতক্ষণ চাই কথা বলা যেতে পারে।

স্কুল লাইফের সেই নিজস্ব সন্তুষ্টির জগত থেকে বেরিয়ে এসে কি আমি আরো সংকীর্ণ কোনো জগতে নিজের আনন্দ-আগ্রহ-সন্তুষ্টির জায়গা খুঁজে নিলাম ? আমার এতদিন তা-ই মনে হয়েছে। “চলো একটু ঘুরে আসি,” “চলো একটু বের হই”, “ওমুকটা খাওয়াও”, “চলো ঐটা খাই”, “চলেন ঘুরতে যাই ওমুক জায়গায়... ” ইত্যাদি কথায় আমি একবাক্যে না করেছি, যখন সেখানে মানুষকে জানার (এবং জানার উদ্দেশ্যেই কথা বলার) সুযোগ না থাকে। আমার আনন্দ-আগ্রহ-সন্তুষ্টির বিষয় যখন মানুষ হয়ে দাঁড়ালো, তখন সেই “মানুষকে” জানার জন্যে যদি ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাটিং করে হাত ব্যথা করে ফেলতে হয়, নির্ঘুম রাত পার করতে হয়, কিংবা গৃহকোণে বন্দী হয়ে থাকতে হয়, তবুও ওতেই আমার আনন্দ !

তাই আর সবার আনন্দ-আগ্রহের জায়গার সাথে আমার আনন্দ-আগ্রহ-সন্তুষ্টির জায়গাটা মিললো না। এই বাইশ-তেইশ বছর বয়স, যেটাকে যৌবন বলা হয়ে থাকে, সেই সময়ে প্রাণের উচ্ছলতায় সমবয়েসীরা যখন দুনিয়ার প্রতিটা জিনিস স্পর্শ করে দেখছে, তখন আর সবকিছুতে নিরাগ্রহ নির্লিপ্ত হয়ে আমি দুজনে পাশাপাশি বসে কথা বলার মাঝেই জগতের সব বিস্ময়, আনন্দ, রূপ আর সন্তুষ্টি খুঁজে পাচ্ছি ! সবাই যখন হাজার বর্গমাইলের এই দেশ কিংবা আরো বহু দেশ ঘুরে এসে হিসেব করছে কতটা পথ হাঁটা হলো, তখন আমি মানুষের হৃদয়ের মাঝে কোটি কোটি বর্গমাইলের অপূর্ব সুন্দর দেশ দেখছি ! সেখানে পথ হাঁটছি প্রতিটা মুহুর্তে, এমনকি ঘুমের মাঝেও !

এরপর… গত এক বছর আগের গল্প। কিংবা তার কিছু কম-বেশি। জীবনে বিশাল বড় এক পরিবর্তন এলো ! আমি সেটাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলাম। সে গল্প এখানে করবার নয়; আসলে সেটা শব্দ করে বলবার গল্প নয়। সম্ভবতঃ সেটা নৈঃশব্দের গল্প, কিংবা নৈঃশব্দের উর্ধ্ব কোনো জগতের গল্প। আমি সেটাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলাম !

এতদিনে কেউ একজন আমাকে কথার জাদুকর বলে ফেলেছে। কথাটা আমার পছন্দ হয়েছে। একারণে নয় যে আমি নিজেকে কথার জাদুকর মনে করি, কিংবা মানুষকে কথা দিয়ে জাদু করবার কোনো ক্ষমতা আমার আছে, বরং এজন্যে যে, “কথার জাদুকর” কথাটার আড়ালে আমি আশ্রয় নিয়েছি, এবং এর মাধ্যমে খুব সহজে কথা-নির্ভর এই আমাকে প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছি। তাই আমি নিজেকে কথার জাদুকর ভেবেছি ! না, জাদুকরের show যারা দেখে, তাদের দৃষ্টিতে না, কথায় মুগ্ধ হওয়া শ্রোতার দৃষ্টিতে না, বরং জাদুকরের নিজের দৃষ্টিতে ! সেটা যে আসলে কেমন, তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কথার জাদুকরেরাও যে কেনো সেই অসহায়ত্বকে ব্যাখ্যা করতে পারে না, সেটা বুঝতে হলে স্বয়ং কথার জাদুকর হতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এ এক অদ্ভুত বাজি ! কথার জাদুকরেরা জগতের আর সকল বিষয় নিয়ে কথার জাদু করতে পারলেও, তাদের নিজেদের গল্পটা কখনোই করতে পারে না। ঐখানটিতে একটা অভিশাপ আছে যেনো ! সবার গল্প সে করতে পারবে, কথা দিয়ে গুছিয়ে দেবে অপরের হৃদয়ের অনুভুতিগুলোকে, ভ্রমণ করিয়ে আনবে অজানা সব আবেগের সূক্ষ্মতম জগত থেকে, কিন্তু নিজের কাছে এসে অসহায় হয়ে পড়বে ! স্বচ্ছ টলটলে পানির হ্রদের তীরে দাঁড়িয়ে তাই যখন সে সকলের পানপাত্র পূর্ণ করে যাচ্ছে অবিরাম, তখন সে নিজেই আর সবার চেয়ে তৃষিত হয়ে আছে !

তার তৃষ্ণা মেটানোর পানি যে আর কোথাও নয়, কেবল পাথরের মাঝেই পাওয়া সম্ভব !
সেই পাথর হ্রদের তীরেই আছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে… সবখানে। কিন্তু সে পাথরে ফাটল ধরাতে হলে হাতদুটিকে মুক্ত করা চাই। অপরের পানপাত্র পূর্ণ করতে ব্যস্ত হাতদুটিকে ছুটি দেয়া চাই। জীবনের আনন্দ-আগ্রহ-সন্তুষ্টির জায়গাটাকে বদলানো চাই।

সেজন্যে ছুটি নিতে হবে ! ছেড়ে দিতে হবে পানপাত্র পূর্ণ করার চাকরি, কিংবা কথার জাদুর শো ! সেই ছুটির নিবেদন, আবেদন অথবা দরখাস্ত কিভাবে করতে হয়, তা-ও আমি আসলে জানি না। “শেষবার” কথাটা যে কিভাবে বলতে হয়, তা আমি কখনো শিখিনি। একই কথা চর্চা করতে করতে মানুষ কথার জাদুকর হয়ে ওঠে। কিন্তু “শেষ” জাদু বারবার চর্চা করার সুযোগ হয় না। তাই সমাপনী বক্তব্য কখনোই জাদুকরের মনমতো হয় না। তার শেষ কথাটা সবসময়ই অসমাপ্ত, imperfect থেকে যায়। অতৃপ্তি থেকে যায় ! কিন্তু সেটা বোধহয় কথার জাদুকর হবার শাস্তি।


নূরে আলম
ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা