এখন ভোর। আকাশের মেঘ দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে। সদা জাগ্রত সশব্দ শহরে এটুকুই নীরবতা। এই একই ভোর, আর আকাশের সেই মৃদু আলোতে মেঘেদের দ্রুত পলায়ন – এই ঘটনা জীবনে হাজারবার ঘটেছে। কখনো সেটা হয়েছে প্রচণ্ড শীতে পুকুর পাড়ে মাছ ধরা দেখতে দেখতে, কখনো মাটির চুলায় পিঠার হাঁড়ির পাশে, কখনোবা বড়দের সাথে হাত ধরে হাঁটতে বের হয়ে, আর কখনো শিশিরভেজা শিউলি ফুল কুড়াতে গিয়ে। অথবা কাগজ-কলম হাতে অঝোর ধারার বৃষ্টি দেখে দেখে। আর অসংখ্যবার এমন ভোর পার হয়েছে নির্বোধের মতন ঘুমিয়ে। অথচ প্রতিটা ভোরেরই আলাদা রহস্য আছে : বেহেশতের রঙ বয়ে আনে তারা। কিন্তু সোনা-রূপায় বন্দী মানুষ তড়িঘড়ি করে রাত্রির অন্ধকার খোঁজে। হতাশ ফেরেশতারা রঙের ডালি নিয়ে ফিরে যায়। "আয় খোদা ! এরা যে নিজেদের দুনিয়ার রঙে রাঙিয়েছে।" সাত আসমানের ওপারে খোদা আবারো মৃদু হাসেন। পরদিন ভোর হলে ফেরেশতারা আবারো আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন বলতে বলতে দুনিয়ায় আসে। রঙের খরিদ্দার খোঁজে।
..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... .....
মানুষেরা কী যেনো বলাবলি করে। দুইজনে, তিনজনে অথবা অনেকে একসাথে। স্বপ্নের গল্প। রঙিন স্বপ্ন। সুখী জীবনের স্বপ্ন, ভালোবাসার গল্প। পাশ দিয়ে ফেরেশতারা হেঁটে যায়। হাতে তাদের রঙের ডালি, আর ডানাদুটো স্বর্গীয় তুলি। কিন্তু কেউ তাকায় না। বোকা মানুষেরা শূন্যের ভিতরে জীবনের রঙ খোঁজে।
..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... .....
লেখক, কবি, সাহিত্যিক। মানুষের হৃদয়াবেগকে তৃপ্ত করতে গান, কবিতা আর গল্প-উপন্যাস লিখে চলেছে অবিরাম। মানুষও শুনছে, পড়ছে, গাইছে। সাহিত্যসভা, গানের আসর, কবিতার মায়াজাল। ফেরেশতারা নেমে আসে আবার। কানের কাছে এসে বলে, আল্লাহ। প্রাণে ভরপুর কবি-হৃদয় চমকে ওঠে – আল্লাহ?
..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... .....
ফেরেশতারা সারা দুনিয়া চষে বেড়ায়। মানুষের কানে ফিসফিস করে কী যেনো বলে। যাদের হৃদয়ের দুয়ার খোলা ছিলো, তাদের অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায় সে কথা।আবারো ভোর হয়। মানুষেরা কী যেনো বলাবলি করে। দুইজনে, তিনজনে অথবা অনেকে একসাথে। স্বপ্নের গল্প। ভালোবাসা, রঙ আর রঙিন জীবনের গল্প। আবারো ফেরেশতারা পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। হাতে রঙের ডালি, ডানাদুটো স্বর্গীয় তুলি। এমন সময় একজন, দুইজন কিংবা আরো কয়েকজন মানুষ চোখ মেলে তাকায়। তারা ফেরেশতাদের বলা কথাটি হৃদয়ে ধারণ করেছিলো। সেই দৃষ্টিতে ফেরেশতার ডানা খসে পড়ে; আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, "রহমান !" খোদা আবারও হাসেন। ফেরেশতা তখন একহাতে দুটি ডানা আর অন্যহাতে রঙের ডালি মানুষটির হাতে তুলে দেয়। রঙের ডালিতে তুলি স্পর্শ করিয়ে মানুষও আকাশের দিকে তাকায়। "ইয়া রহমান ! ইয়া রহিম !"
এরপর নতুন গল্প শুরু হয়।
..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... .....
বছর বছর শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা পার হলে, একটা করে রমজান আর দুটি করে ঈদ পার হলে, আর একটি করে জন্মদিন পার হলে সময়ের দাগ পড়তে থাকে। এইযে আরো একটা বছর অতীত হয়ে গেলো, এর স্মৃতি থেকে নিস্তার নেই। অনন্তকাল একে বয়ে বেড়াতে হবে। মানুষকে যে অনন্তকাল বেঁচে থাকতে হবে, এই বিষয়টা কেউ-ই অনুভব করে না বোধহয়। অথচ এইযে একটা মানুষের জন্ম হলো, তার আর শেষ নেই। অনন্তকাল বেঁচে থাকার জন্যেই সে এসেছে। দুনিয়ার জীবনের পর্বটা শেষ করার পর হয় সে চিরস্থায়ী আগুন, নয়তো চিরস্থায়ী খোদায়ী সান্নিধ্য লাভ করবে। কিন্তু সেটা এই জীবনেরই ধারাবাহিকতা। মানুষ যেনো মনে না করে যে, মৃত্যুর মাধ্যমে তার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে।
..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... .....
আমি আজকে প্রায় এক বছর পর ব্লগ লিখতে বসেছি। ব্লগ লেখা বলতে ব্যক্তিগত আলাপ, কিংবা একটু আগের হেঁয়ালিপূর্ন কথাবার্তা, এইরকম। আমি অস্থির মানুষ, কোনো একটা বিষয়ে দীর্ঘসময় লেগে থাকা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু আরো অনেক কিছু ছেড়ে দিলেও লেখালেখিটা আমি ছাড়তে পারিনি। ছোটবেলায় গল্প লেখা থেকে শুরু করে ক্লাস সিক্স-এ ডায়রি লেখার অভ্যাস হওয়া, আর এরপর এখন পর্যন্ত ডায়রি লিখে যাওয়া। ক্লাস এইট কিংবা নাইন থেকে ব্লগিঙের শুরু, তারপর সেটাও আজকে পর্যন্ত চলছে। কখনোবা খুব ফ্রিকোয়েন্ট লিখেছি, কখনোবা আবার মাসের পর মাস লেখা হয়নি। কিন্তু লিখেছি। কমিউনিটি ব্লগে, ব্যক্তিগত ব্লগে। লেখা থামেনি। বাকী ভাইবোনেরাও যখন লেখালেখি থামিয়ে দিলো প্রায়, তখনও আমি লিখে চলেছি। এখনতো লেখালেখি আমিই যা একটু করি, বাকিরা সব থেমে গিয়েছে। অবশ্য তারা সবাই-ই আমার চেয়ে ভালো লেখে, ভালো লিখতো।
দীর্ঘদিন ব্যক্তিগত বিষয়ে ব্লগ লিখিনি। আর লিখবার ইচ্ছাও ছিলে না। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু কারণে আবারো লিখছি। লিখছি ভালোবাসার দায়বদ্ধতা থেকে, কিংবা স্বতঃস্ফূর্ত ঝর্ণাধারার মত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। লিখছি আরো এক আশা থেকে যে, হয়তো কথাগুলি খোদার ইচ্ছায় শক্তি অর্জন করবে।
..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... .....
তারপর সেই নতুন গল্প। আকাশে উড়ে বেড়ানো শঙ্খচিলের গল্প। মানুষ কখন শঙ্খচিল হয়, জানেন ? যখন সে বেহেশতের রঙে জীবন রাঙায়, আর পাখাদুটি পরে নেয় ফেরেশতার। তারপর ডানা মেলে আকাশে। তেমনি এক শঙ্খচিল। সুতীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি, আর ওড়ার মনোমুগ্ধকর গাণিতিক ছন্দ। বারবার দেখেও সে মুগ্ধতা শেষ হয় না – মুক্তিলাভের এ-ই বুঝি আনন্দ ! তাই দেখে দালান কোঠার ঘুলঘুলিতে বাসা বাঁধা পাখিরও অসীমাকাশে উড়বার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু তার ডানাদুটি ছোটো, উড়বার শক্তিও কম। সে তাই ছোটপাখি, শঙ্খচিলের ছোট্টবন্ধু। কিন্তু রহমান রহিম খোদা কেবল শঙ্খচিলের জন্যই নয়, সে ছোটপাখির জন্যও। এমনকি দুনিয়ার মায়ায় বাঁধা পড়া দুপেয়ে মানুষদের জন্যও; তাদের জন্য খোদা ফেরেশতা পাঠান, আর তারা ফিসফিস করে বলে যায় মুক্তির মূলমন্ত্র !
..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... .....
হতাশ মানুষের দীর্ঘশ্বাস আকাশের যে পর্যন্ত ওঠে, তার ঠিক উপর থেকেই বেহেশতের জীবন শুরু। বেহেশতের রঙে রঙিন হতে হলে ফেরেশতার ডানায় ভর করে আকাশের সেই স্তর অতিক্রম করা চাই। ওটুকু পার হতে পারলেই প্রশান্তি। এরপর এটা অন্য এক দুনিয়া। দুপেয়ে মানুষেরা আকাশে একবার তাকিয়ে মাটিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে; বলে, ও কিছু না, পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু খোদা জানেন সে পাখির অন্তরে কী রয়েছে ! এমনি করে মর্ত্যের মানুষ স্বর্গ লাভ করে। আকাঙ্খার আকাশ পেরিয়ে খোদার পরম সান্নিধ্যের আকাশে প্রবেশ করে। এখানে কেবল খোদার জন্যে ভালোবাসা আছে, প্রেম আছে, আর প্রেম আছে খোদাপ্রেমীদের জন্য। এখানে আমি, তুমি, তোমরা, নারী, পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ বলে কিছু নেই – খোদার আরশের ছায়ায় সবাই যেনো এক আত্মা, এক প্রাণ।
..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... .....
সেই হতাশার আকাশের পর থেকে শুরু হয় সাত আসমান। প্রতিটা আকাশেই এত রঙ, এত রূপ, এত অজানা রহস্য – আহ ! কেউ কি আর ফিরে যেতে চায় তুচ্ছ মর্ত্যসুখের আশায় ? এরপর শঙ্খচিল আরেক আসমানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ছোটপাখিকে সাথে করে নিয়ে যায়, বুকের ডানপাশটিতে, ডানার নিচে লুকিয়ে। বাঁধ ভাঙা স্রোতে জোয়ার আসে। সে ভালোবাসার তীব্রতায় ছোটপাখি কাঁপতে থাকে। কথার জাদুকর অশ্রুসজল ছোটপাখি অস্ফূট স্বরে কী যেনো বলে। শঙ্খচিল বলে – উঁহু, আমরা আরো এক আসমান পার হয়ে এসেছি। এখানে কেউ কথা বলে না। Silence is the language of God.
ছোটপাখি ডানার মধ্যে মুখ লুকায়। কথার জাদুকর, ভালোবাসার জাদুকর হয়ে ওঠে।
নূরে আলম
জুন ১১, ২০১৪।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
[ব্লগে কমেন্ট পোস্ট করার পরও যদি না দেখায়, তাহলে দ্বিতীয়বার পোস্ট করার প্রয়োজন নেই। খুব সম্ভবত স্প্যাম গার্ড সেটাকে সরিয়ে নিয়েছে, আমি পাবলিশ করে দেবো।]