সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

একটি বাংলাদেশ, অনেকগুলো লোলুপ দৃষ্টি, আর আমাদের সাময়িক বিজয়োল্লাস

বাংলাদেশের রাজনীতিকে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে চিন্তা করাটা বোকামী। এটা খুবই দুঃখজনক যে, বাংলাদেশের মত ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন এলাকার অধিবাসীদের রাজনৈতিক চিন্তা হাসিনা-খালেদার ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। অথচ বিশ্ব ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ভূখণ্ডের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব দিনদিন বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতিক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সর্বোপরি সচেতন মানুষের পক্ষে আর হাসিনা-খালেদা ও বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া-আমেরিকার সরল সমীকরণে থাকা চলবে না। বরং এই দেশ ও এর জনগণ আরো বড় সমীকরণের অংশ; বিশ্ব ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের একটি নিয়ামক, যা কিনা কিছুদিন আগে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে চীন।

বাণিজ্যিক বিষয় ছাড়া চীন সাধারণতঃ কোনো দেশের রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলে না। খুব সচেতনভাবেই তারা এটাকে এড়িয়ে চলে। দিল্লিকা লাড্ডু হলেও সারাবিশ্ব যেখানে গণতন্ত্রের এক দুর্বোধ্য স্ট্যান্ডার্ডের সাথে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে, সেখানে গোটা বিশ্ব ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্যোশালিস্ট রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছে চীন। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বহির্বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকে জনগণকে কার্যতঃ বিচ্ছিন্ন রেখেও তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে নেই তারা। ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার দেশটির তথ্যপ্রযুক্তি চলছে ফেসবুক-গুগল ছাড়াই, বরং তারা গড়ে তুলেছে নিজস্ব ইন্টারনেট জগৎ। সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও অনেক এগিয়ে গিয়েছে চীন, বিশেষতঃ প্রযুক্তি খাতে, যা এমনকি আমরাও মোটামুটি ধারণা করতে পারি।

বাংলাদেশের রাজীতির কথা শুরু করে চীনের কথা কেনো আনলাম, সেটা বোধকরি শুরুতেই বুঝিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশে বিশ্ব মোড়ল ও মোড়ল-হতে-ইচ্ছুকদের ক্রমবর্ধমান ইন্টারেস্ট এর কারণেই চীনের সম্পর্কে বলা। আরো বলা প্রয়োজন যে, সম্প্রতি বিশ্ব মোড়লগিরিতে মার্কিন আধিপত্যে ফাটল ধরেছে। সিরিয়া ইস্যুতে আমেরিকা একবার পরাজিত হলো ইরানের কাছে। সিরিয়া আক্রমণের মাধ্যমে ইরানের সিকিউরিটি বেল্ট ভেঙে ফেলার ইহুদী চক্রান্ত বাস্তবায়ন থেকে সরে আসতে অনেকটা বাধ্য-ই হয়েছে আমেরিকা; ইরান ও ইরান সমর্থিত লেবানিজ সংগঠন হিজবুল্লাহর হুমকিতে। এই ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মোড়লগিরি আর আগের মত থাকলো না। সেইসাথে ঐ অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ইরান, রাশিয়া ও চীন, বিশেষতঃ ইরান ও রাশিয়ার ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। দ্বিতীয়বার আমেরিকার পরাজয় হলো মাত্র কিছুদিন আগে। ইরানের উপর থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে ও ইরানের পরমানু অধিকার মেনে নিয়ে কার্যতঃ নিজেদের পরাজয় ও ইরানের শক্তিকে স্বীকার করে নিলো ছয় জাতিগোষ্ঠী, আর এখানে মূল পরাজয়টা ছিলো আমেরিকার।
এটা নিঃসন্দেহ যে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার আর আগের মত ক্ষমতা নেই, যদিও সেনাশক্তি এখনও বিদ্যমান। রাজনৈতিক কৌশলের কাছে যে ব্রুট ফোর্স পরাজিত হতে পারে, তার চমৎকার উদাহরণ দেখালো ইরান : প্রথমবার সিরিয়া ইস্যুতে, আর দ্বিতীয়বার তাদের পরমানু অধিকার আদায় ও অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য করার মাধ্যমে।

এই দুটি ঘটনা, যা মার্কিন মোড়লগিরিকে অনেকটাই সীমিত করে এনেছে, তা সম্ভব হয়েছে ইরান, চীন এবং রাশিয়ার সম্মিলিত রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে। আধুনিক বিশ্ব বহুদিন যাবৎ যেমনটা দেখে আসছে, অর্থাৎ গোটা দুনিয়ার উপর একটি দেশের (আমেরিকার) খবরদারী – তা শীঘ্রই বদলে যাচ্ছে। এক মোড়ল বিশ্বব্যবস্থার বদলে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো এখন চাইছে বহু-মোড়ল-বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে কোনো একটি দেশ সারা দুনিয়ার উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করবে না, বরং বড় বড় শক্তিগুলো পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। অর্থাৎ, সম্ভবতঃ খুব শীঘ্রই আমরা মার্কিন একচ্ছত্র আধিপত্যবিহীন একটি বিশ্ব দেখতে যাচ্ছি, যেখানে কিছু না কিছু ক্ষমতার সাম্য আছে, যেখানে কোনো একটি দেশ মোড়লগিরি করছে না, বরং বড় বড় শক্তিগুলো পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে বৈশ্বিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ করছে। আর মার্কিন মোড়লগিরিকে সীমিত করে এনে সেই বহু-মোড়ল-বিশ্বব্যবস্থার রূপরেখা তৈরী করছে ইরান, চীন ও রাশিয়া।

আবার চীনের কথায় চলে আসি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে চিন্তা কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকায় একটি সংবাদ আমাদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে। সংবাদটি হলো, চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যে, চীন তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলারকে সরিয়ে দেবে। প্রাসঙ্গিকতা রক্ষার খাতিরে ডলারের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি না, তবে বিশ্বে মার্কিন আধিপত্যের পিছনে ডলারের ভূমিকা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এটি কত বড় ধরণের একটি ঘটনা। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতি চীন যখন মার্কিন কারেন্সি ডলারকে বহিষ্কার করলো, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকার সেটা ভালো লাগার কথা নয়। ইন ফ্যাক্ট, এটা আমেরিকার জন্য সিরিয়া-ইরান ইস্যুর পর মরার উপর খাঁড়ার ঘা এর মত লেগেছে। এতে গোটা এশিয়ায় মার্কিন আধিপত্য দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আজ হোক কাল হোক যখন চীন ডলার ভিন্ন অন্য কোনো মুদ্রায় বিশ্বের সাথে লেনদেন করবে, তখন মার্কিন মোড়লগিরিতে বাধা তো পড়বেই, উপরন্তু চীনের উপর নির্ভরশীল বাণিজ্যগুলোর ক্ষেত্রে খোদ আমেরিকারও পায়ে শেকল পড়বে। এগুলো বুঝতে ৫০ বছরের ভবিষ্যৎবাণী করার দূরদৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। মার্কিন অর্থব্যবস্থা যে খোসাসর্বস্ব হয়ে পড়েছে, তা এখনই সাধারণ মানুষের কাছে প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে।

যাহোক, যেই বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে এতগুলো কথা বলা, সেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যাপারে সম্প্রতি চীন দুই থেকে তিনবার বক্তব্য দিয়েছে। তারা বলছে যে, এদেশে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক এবং 'গণতান্ত্রিক' পরিস্থিতি তাদের 'দরকার'। এদিকে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ-নির্ধারণের ব্যাপারে ইন্ডিয়া ও আমেরিকা তো এখন সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দেশাইরা এসে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে, ইনস্ট্রাকশান দিয়ে যাচ্ছে, তাদের সচিব পর্যায়ের মানুষের জন্য এদেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের হরতাল-অবরোধ স্থগিত করছে, আবার ড্যান মজিনা ইলেকশান নিয়ে একবার ইন্ডিয়া, একবার আমেরিকা, একবার চীন পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করছে, ওদিকে আবার ইন্ডিয়ায় বারবার বৈঠক বসছে এখানকার ইলেকশানের ব্যাপারে, মার্কিন রাজনীতিকরা আলাদা বৈঠক করছে বাংলাদেশের অবস্থা আলোচনা করার জন্য...। তো যা বলছিলাম, ইন্ডিয়া-আমেরিকা-ই যে এদেশের রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক, তা অনেকেই জানেন। যেটা বলার জন্য এই লেখা লিখছি, তা হলো চীনের হস্তক্ষেপ।

আওয়ামী লীগ সরকারের এই পাঁচ বছরে ইন্ডিয়া তো বাংলাদেশকে পুরোপুরি ভোগ করেছেই, আরো বেশি ভোগ করবে আরেকবার লীগ ক্ষমতায় এলে। বহির্বিশ্বের সাথে প্রায় সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে শেখ হাসিনা শুধুমাত্র ইন্ডিয়ার সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। আমরা পুরোপুরিভাবে ইন্ডিয়া নির্ভর হয়ে পড়ছি। বড় বড় বিশ্লেষক মহলে এটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বে এদেশের উপর অ্যাবসলিউট অথরিটি ইন্ডিয়ার জন্য নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সুতরাং স্বাধীন রাষ্ট্র সিকিমকে গ্রাস করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ইন্ডিয়া যে বাংলাদেশকে অনুরূপভাবে গ্রাস করার ইচ্ছা পোষণ করে না, তা বলা যায় না। যদিও আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়ায় ইন্ডিয়াকে পুলিশের দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে দেখতে চায়, তবুও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, বিশেষতঃ সমর ও বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে ইন্ডিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে, এটা আমেরিকা চায় না। সুযোগ পেলে বিশ্বমোড়ল হবার বাসনা সবারই আছে, আর আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় গেলে সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের সীমানাকে কার্যতঃ মুছে দেবে ইন্ডিয়া – বাংলাদেশ হবে ইন্ডিয়ার একটি অঙ্গরাজ্য। দক্ষিণ এশিয়ার এক অতি শক্তিশালী রাজা হিসেবে আবির্ভূত হবে ইন্ডিয়া, চীনকে টেক্কা দেবার জন্য পেয়ে যাবে বঙ্গোপসাগরের কন্ট্রোল।
এদিক থেকে আওয়ামী লীগকে চাইছে শুধুমাত্র ইন্ডিয়া, আর চাইছেনা চীন ও আমেরিকা। (ইন্ডিয়ার পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এরশাদের সাথে বৈঠকের পর প্রেসের সাথে কথা বলেননি, কিন্তু এরশাদের ভাষ্যমতে সুজাতা সিং বলেছেন যে এরশাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে জামাত ক্ষমতায় চলে আসবে। জবাবে এরশাদ বলেছেন, কে আসলো না আসলো তা আমার দেখার বিষয় নয়। অর্থাৎ, বিএনপি-জামাতের সরকার ঠেকাতে ও আওয়ামী লীগকে আনতে মরিয়া ইন্ডিয়া।)

এদিকে আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে হাসিনাকে ক্ষমতায় চাইছে না আমেরিকা। তা হলো, চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন ক্ষমতা অতি সীমিত হয়ে আসছে নিকট ভবিষ্যতে। আর এর পিছনে প্রধান কারণ হবে চীন কর্তৃক ডলারকে বহিষ্কার করা। এমতাবস্থায়, মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রতি হেরে যাওয়া আমেরিকা, এশিয়ার উপর থেকেও তার নিয়ন্ত্রণ চলে যাক, তা চাইবে না। এজন্যে চীন কর্তৃক ডলার বহিষ্কৃত হলেও বাংলাদেশের উপর ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণের মাধ্যমে যদি বঙ্গোপসাগর দিয়ে এই অঞ্চলের বাণিজ্য ও সমর নিয়ন্ত্রণ করা যায়, বিশেষতঃ সমর, তবে একদিকে যেমন চীনকে নতুন বিশ্বের মোড়ল হওয়া থেকে ঠেকানো যায়, তেমনি অপরদিকে ইন্ডিয়াকে চোরের উপর বাটপারি করে দক্ষিণ এশিয়ায় একচ্ছত্র রাজত্ব করা থেকে ঠেকানো যায়। অর্থাৎ, সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায় যে, বাংলাদেশের উপর ইন্ডিয়ার রাজত্ব আমেরিকা চাইছে না দুটি কারণে : এক. চীন কর্তৃক ডলার বহিষ্কার হবার পর দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের (ভবিষ্যতে) রাজা হয়ে ওঠাকে ঠেকাতে হলে বাংলাদেশের উপর মার্কিন বাণিজ্যিক ও সামরিক আধিপত্য প্রয়োজন। এটা সম্ভব হবে স্থানীয় সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে (তড়িঘড়ি করে সম্পাদন করা টিকফা চুক্তি স্মর্তব্য)। দুই. আওয়ামী লীগের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর ইন্ডিয়ার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার হলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক শক্তি বিস্তার করা কঠিন হয়ে পড়বে, কারণ সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণ একবার পেয়ে গেলে চোরের উপর বাটপারি করে ইন্ডিয়া নিজেই এখানে রাজা সেজে বসবে। যার ফলে দক্ষিণ এশিয়া মোটামুটি হাতছাড়া-ই হয়ে যাবে বর্তমান দুর্বল আমেরিকার।

চীনের পারস্পেক্টিভ কিছুটা ভিন্ন। ইরান, রাশিয়া ও চীনের বহু-মোড়ল-বিশ্বব্যবস্থার যে রূপরেখা, তাতে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও রাশিয়ার শক্তি থাকবে মূলত। আর দক্ষিণ এশিয়ায় (অথবা বৃহত্তর এশিয়ায়) রাশিয়া ও চীনের, বিশেষতঃ চীনের। সেই বহু-মোড়লের নতুন বিশ্বব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার বর্তমান ভারসাম্য বদলাতে হবে। সেজন্যে চীনের প্রতি বন্ধুসুলভ সরকার প্রয়োজন, যে কাজটা কূপমণ্ডূক আওয়ামী লীগ আঞ্জাম দেবে না। তারা হঠকারীর মত ইন্ডিয়ার হাতে দেশ তুলে দেবে, অনেকটা দিয়েও দিয়েছে ইতোমধ্যে। একারণে অতি সতর্ক চীনও এখন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে। তবে আওয়ামী লীগকে সরানো হলে এবং বিএনপিকে শক্তিশালী করে ক্ষমতায় বসানো হলে তা অ্যাক্টিভলি করবে আমেরিকা। আর প্যাসিভলি করবে চীন।

মোদ্দা কথা, হাসিনা ক্ষমতায় এলে এই অঞ্চলের রাজা হয়ে উঠবে ইন্ডিয়া, কারণ তারা ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের এই বঙ্গোপসাগরকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে। আমেরিকা যেখানে চীনের মোড়ল হয়ে ওঠা ঠেকাতে ব্যস্ত, এবং ডলার বহিষ্কারের ঘটনায় অতি চিন্তিত, এমতাবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহৎ শক্তি হিসেবে ভারতের আবির্ভাব সে চায় না। আর চীনতো সেটা চায় না আরো বেশি। এখন আমাদের বাংলাদেশীদের এই কারণে আওয়ামী লীগ, তথা ইন্ডিয়ার হাত থেকে আপাতঃ রেহাই পাবার একটি সুযোগ তৈরী হয়েছে। কারণ দুই মোড়ল আমেরিকা ও চীনের দ্বন্দ্বের কারণে উভয়েই হাসিনাকে সরিয়ে অন্য কোনো সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চাইছে; এমন সরকার, যার মাধ্যমে তারা লাভবান হবে, ইন্ডিয়া নয়। আরেকবার হাসিনা এলে এখানে চীন ও আমেরিকা দু'জনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় – ইন্ডিয়া শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হবার চেষ্টা করবে। সুতরাং বিএনপি-জামায়াতের একটি সরকার এখন আমেরিকা ও চীন উভয়ের জন্যই ভালো। এতে নতুনকরে চাগিয়ে ওঠা প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঠেকানো গেলো। আর বিএনপি-জামাতকে ক্ষমতায় এনে তার কাছ থেকে প্রত্যেকেই লাভ উঠানোর চেষ্টা করবে। তখন আবার আমরা আমেরিকা-চীনের দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়বো। তবু আপাতত তো বাঁচবো !

সম্প্রতি ড্যান মজিনা আমার দেশ পত্রিকা ও দিগন্ত টিভিসহ বন্ধ সব মিডিয়া খুলে দিতে 'নির্দেশ' করেছে তথ্যমন্ত্রীকে। মুক্তি দিতে বলেছে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের আদিলুর রহমানকে। মাহমুদুর রহমানও মজিনা কর্তৃক মার্কিন নির্দেশে মুক্তি পেলে বিস্মিত হবো না। আমার দেশ পত্রিকার পাবলিকেশান চালু হওয়া এবং দিগন্ত টিভির সম্প্রচার শুরু হওয়া – এই দুটি যে লীগ সরকারকে আরো দুর্বল করে ফেলবে, তাতো স্পষ্ট। নইলে এতদিন পর হঠাৎ করে এই পত্রিকা ও টিভির জন্য মার্কিন দরদ জেগে ওঠার কারণ কী ?
আনপ্রেডিক্টেবল এরশাদ বহু ডিগবাজির পর হঠাৎ ৩০ ঘন্টার জন্য হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। এই ৩০ ঘণ্টায় কার কার সাথে দেখা হয়েছে বলতে পারছি না। তবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারসহ আওয়ামী লীগের একদলীয় নির্বাচন বর্জনের ঘটনাটি যদি স্থিতিশীল হয়, অর্থাৎ এরশাদ আরেক দফা ডিগবাজি না দেন, তবে তা আওয়ামী সরকারকে সত্যিই দুর্বল করে দেবে। এমনকি এরশাদ যদি আগামীকাল-ই নির্বাচনে যাবার ঘোষণা দেয়, তবুও এরশাদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় আওয়ামী লীগ সরকারের গদি ইতোমধ্যে নড়ে উঠেছে। এই ঘোষণাটা বিএনপি-জামাতের চলমান আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করেছে। এদিকে আবার নিশা দেশাই এর মাধ্যমে আমেরিকা সতর্ক করে দিয়েছে যে, হাসিনা যেনো আর্মিকে দিয়ে কিছু করতে না চায়।

হঠাৎ ড্যান মজিনা কর্তৃক বন্ধ পত্রিকা ও টিভি খুলে দিতে বলা, আমেরিকায় বসে নিশা দেশাই এর ঘোষণা দেয়া যে, কোনোরকম সামরিক হস্তক্ষেপ দেখতে চায় না আমেরিকা, আবার এরশাদের আকস্মিক নির্বাচন বর্জন – এই সব দেখে মনে হয় যে, আমেরিকা বোধহয় আর আওয়ামী লীগকে চাইছে না। বিএনপি-জামাতের ভারসাম্যপূর্ণ সরকারকেই কামনা করছে তারা। যদি তা-ই সত্য হয়, তবে আমরা শীঘ্রই নাটকীয় পরিবর্তন দেখতে যাচ্ছি বাংলাদেশের রাজনীতিতে।

দুঃখ লাগে এই ভেবে যে, এখন যদি বিএনপি-জামাতের এই অবরোধ 'সফল' হয় এবং তাদের দাবী মোতাবেক কেয়ারটেকার এসে অতঃপর তারা ক্ষমতায় আসে, তারা ভাববে যে তারা বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু আসল বিজয় যাদের হবে, তাদেরকে কি আমরা কিছু করতে পেরেছি ? তাদেরকে চোখ রাঙানোর সাহস কি আমাদের কোনোদিন হবে ? আমাদের কি কোনোদিন এই সাহস হবে যে ইরানের মত করে ইহুদি-মার্কিন হুমকি উপেক্ষা করে উল্টো আমেরিকাকে হুমকি দেবো ? চীনকে বলবো : নিজের চরকায় তেল দাও ? ইন্ডিয়াকে বাড়াবাড়ি না করার কথা বলবো ?
সেটাইতো এই ভূখণ্ডের মানুষের জন্য হবে প্রকৃত বিজয়। সে বিজয় আমরা ১৯৭১ এও অর্জন করতে পারিনি, আর ২০১৩ তেও পরছি না। কবে পারবো, তা জানি না।

নূরে আলম

ডিসেম্বর ৪, ২০১৩।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ...

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা ...