আমার একটা মেটালের চাবির রিঙ ছিল, সেটা হাতে নিলে প্রথমে একটু শীতল অনুভব হতো, কিন্তু খানিক পরেই হাতের উষ্ণতায় সেটা গরম হয়ে উঠত আর -- তখন আর সেটাকে ধরে রাখতে ভালো লাগত না। তখন আমি স্কুলে পড়ি।
সেজাপুকে বললাম, "এই চাবির রিঙটা হলো মানুষের মত, বেশিক্ষণ এর সঙ্গ আমাকে আনন্দ দিতে পারে না।" সেজাপু তাই নিয়ে আমাকে বেশ গঞ্জনা দিলো। কথাটার জন্য কেন তিরস্কৃত হয়েছিলাম, তার ব্যাখ্যাটা সেজাপুই ভালো দিতে পারবে।
এক যুগ পর, এস্তোনিয়ায় বসে মুজাহিদ আমাকে বলছে, "শুধুমাত্র মানুষের ভালোবাসা একটা সময় মানুষকে ক্লান্ত করে ফেলে।" আমি সম্পূরক কথাটুকু বললাম: "অবশ্যই স্রষ্টার সান্নিধ্য ও খোদাপ্রেমের একটা জায়গা মানবজীবনে থাকতে হবে।" আমি জানি না এখন সেজাপুর মন্তব্য কী হবে।
আমার বয়স সাতাশ, এর মাঝে আমি বহু মানুষের সান্নিধ্যে খুব দ্রুত ক্লান্ত হয়ে গেছি। ভালোবাসা পেয়েছি, ভালো বেসেছি, তারপর ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। জ্যোতিষবিদ কিরো একথা বহু আগে বলেছিল, এবং স্কুলে থাকতেই সেকথা আমি জেনে গিয়েছিলাম: বুধ গ্রহের 'কু'-প্রভাব এটা। কিন্তু জ্যোতিষীরা আমাকে যা জানাতে পারেনি, তা আমি জেনেছি সুফিদের কাছে: "গায়রুল্লাহ মাত্রই মানুষকে ক্লান্ত করে।" তখন একযুগ পর আমি মুজাহিদের কথাটা ব্যাখ্যা করতে পেরেছি: "মানবজীবনে খোদাপ্রেমের একটা জায়গা অবশ্যই থাকতে হবে।"
তারপর আমি খোদাতায়ালাকে ভালোবেসেছি। অবশ্যই সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে নয়, বরং অল্প একটুখানি দিয়ে। যদি সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে খোদাকে ভালোবাসতাম, তবে বিনিময়ে তিনি উপহার হিসেবে আমাকে মৃত্যু দান করতেন। যেহেতু এখনো জীবিত আছি, তার মানে আমি তাঁকে সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসিনি।
চিন্তা করবেন না, এতে গুনাহ নেই, এটা দোষেরও নয়। কিন্তু -- আমি তাঁকে অল্প করে যতটুকুই ভালোবেসেছি, সে অনুযায়ী তিনিও আমাকে ভালোবেসেছেন। তখন সেই একই মানব-সঙ্গ, যা আমাকে ক্লান্ত করে ফেলত, তা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এখন আর তা আগের মত ক্লান্ত করে না।
না, এটা আমার কোনো অর্জন না, আমার ব্যক্তিগত কোনো যোগ্যতাও না। আমি স্রষ্টাকে ভুলে গেলে মানুষের ভালোবাসাও আমার কাছে আবার অসহনীয় হয়ে উঠবে: দমবন্ধ করা ক্লান্তিকর অনুভূতিতে বন্দী করবে।
'ভ্যালেন্টাইনস ডে'-র পক্ষে-বিপক্ষে খুব বেশি বলার কিছু নেই। এটাকে হারাম ফতোয়া দিয়েও আপনি মানুষের তেমন কোনো উপকারই করতে পারবেন না, যদি না সে ব্যক্তি খোদাতায়ালাকে ভালোবাসে। আপনার দেয়া হারাম ফতোয়ায় সে হয়ত চোখমুখ কুঁচকে ঘরের মধ্যে বসে থাকবে, কিন্তু তার মন কোনো এক সঙ্গী/সঙ্গীনির ভালোবাসার জন্য হাহাকার করবে। তারপর বৈধ উপায়ে হোক কি অবৈধ উপায়েই হোক, যখন সে একজন ঘনিষ্ঠ ভালোবাসার মানুষ পাবে, তার সাথে ভালোবাসায় ডুবে থাকবে ক'টা বছর। তারপর একটা সময় সেই 'ভালোবাসার সংসার'-এ অযাচিত সব সমস্যা, ঔদাসীন্য, ক্লান্তি ও উপেক্ষার উদয় ঘটবে। তখন সবকিছুর বিনিময়ে সে শান্তি খুঁজবে। তখন আর এই নারী-পুরুষের ভালোবাসা, বন্ধু-আড্ডা-গান -- কোনো কিছুই তাকে টানবে না।
তারপর শান্তি তথা খোদাপ্রেম যদি সে খুঁজে পায় তো ভালো, নতুবা ঐ একই চক্রে বন্দী হয়ে থাকবে। সেক্ষেত্রে পার্টনার চেইঞ্জ, বন্ধু চেইঞ্জ, জব চেইঞ্জ কিংবা এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে থাকা -- ইত্যাদি করার চেষ্টা করবে। কারণ যেই নারী/ পুরুষ/ বন্ধু/ জব/ আরাম-আয়েশ তার এতদিনের আরাধ্য ছিল, কিছুদিন ভোগ করার পর শান্তির উপদানের অভাবে সেসবই আজ তার কাছে 'অশান্তির বিষয়' বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু অন্ধকারকে যতই পায়ে ঠেলেন, এক অন্ধকার থেকে আরেক অন্ধকারেই গিয়ে পড়বেন, যদি না আলোর কাছে যান। এভাবেই উপভোগ্য নরক ও যন্ত্রণাদায়ক নরকের মাঝে চক্রাকারে বহু মানুষের জীবন অতিবাহিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
একমাত্র ধার্মিক-খোদাপ্রেমিক মানুষেরাই পারে দীর্ঘদিন ধরে ভালোবাসার সম্পর্কগুলোর স্বাদ নিতে। বাকিদের অবস্থা হয় ঐ মেটালের চাবির রিঙের মত: হাতে নেবার কিছুক্ষণ পরেই আর ভালো লাগে না, ক্লান্তি চলে আসে। তখনইতো ব্রেকআপ, ডিভোর্স, বন্ধুত্ব শেষ, সম্পর্ক শেষ ইত্যাদি ব্যাপারগুলো আসে, তাই না?
অতএব, আমাদের সকলকেই সামগ্রিকভাবে খোদামুখী হতে হবে। তবেই কেবল মানুষের ভালোবাসাগুলো উপভোগ্য ও মধুর হবে, কখনো শাস্তি হয়ে উঠবে না।
নূরে আলম
ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
[ব্লগে কমেন্ট পোস্ট করার পরও যদি না দেখায়, তাহলে দ্বিতীয়বার পোস্ট করার প্রয়োজন নেই। খুব সম্ভবত স্প্যাম গার্ড সেটাকে সরিয়ে নিয়েছে, আমি পাবলিশ করে দেবো।]