সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন।)
আহমেদ দিদাত (১৯১৮-২০০৫) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা. জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা. জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত, যিনি কিনা ডা. জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন "দিদাত প্লাস" – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ।
যাহোক, ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব-পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত, সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া-সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা হয়। কোথাওবা অডিও নিঃশব্দ হয়ে যায়। এসব অসুবিধা সত্ত্বেও অনুবাদ করেছি, আশা করি মূল ভাবার্থ বজায় থাকবে। তবে ইংরেজীতে যারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাদেরকে অনুরোধ করছি সরাসরি ইংরেজিঅডিও শুনতে। কারণ আহমেদ দিদাতের চমৎকার বাচনভঙ্গিকে খুব কমই ভাষায় রূপান্তর করা সম্ভব।
নূরে আলম।
ইরান : একটি জাতির পুনর্জন্ম”
Iran : A Nation Reborn”

বক্তা : আহমেদ দিদাত

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। পবিত্র কুরআনে আছে :
... যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এরপর তারা তোমাদের মত হবে না।” ( সূরা মুহাম্মাদ, ৪৭:৩৮ )

জনাব চেয়ারম্যান এবং ভাইয়েরা ! যখন আমরা নতুন করে জন্ম নেয়া এক জাতির মিরাকলের দিকে সন্দিগ্ধচোখে তাকাচ্ছি, আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় বিধান তার পরিপূর্ণতা খুঁজে নিচ্ছে বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতনে; যা সূরা মুহাম্মাদের ঐ আয়াতে বলা আছে। আয়াতটির শেষাংশে আল্লাহ তায়ালা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন ও সতর্ক করছেন যে, যদি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন না করি, তবে তিনি আমাদেরকে অন্য কোনো জাতি দ্বারা বদলে দেবেন ( আমাদের বদলে অন্য কোনো জাতিকে উচ্চ ও সম্মানিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন)

নিজেদের কমিউনিটিতে কোনো অযাচিত ঘটনা ঘটলে আমাদের উর্দুভাষী ভাইয়েরা এই কথাগুলোকে খুব সুন্দর করে ব্যবহার করেন যে, অন্য কোনো জাতিকে আল্লাহ তাদের বদলে অধিষ্ঠিত করবেন। এবং এই ঘটনা ইতিহাসে বারবার ঘটে আসছে। আল্লাহ তায়ালা প্রথমে ইহুদীদের (বনী ইসরাঈল) পছন্দ করলেন :
হে বনী ইসরাঈলগণ ! তোমরা স্মরণ কর আমার অনুগ্রহের কথা যা আমি তোমাদের উপর করেছি এবং (স্মরন কর) সে বিষয়টি যে, আমি তোমাদের উচ্চমর্যাদা দান করেছি সমগ্র বিশ্বের উপর।(সূরা বাকারা, :৪৭)
এই মর্যাদাটি ছিল এই যে, তারা দুনিয়ায় আল্লাহর জ্ঞানের দিশারী হবে। এই সম্মান, এই সুবিধাই ইহুদীদের প্রথমে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু যেহেতু তারা দায়িত্ব পালন করেনি, খ্রিষ্টান গসপেল অনুযায়ী ইহুদীদের মধ্য থেকেই একজন ইহুদী, হযরত ঈসা (.) তাদেরকে বললেন : “সদাপ্রভুর রাজত্ব তোমাদের থেকে নিয়ে নেওয়া হবে, এবং এমন এক জাতিকে দেওয়া হবে, যারা (সদাপ্রভুর) কাজ আঞ্জাম দেবে।” (বাইবেল, ম্যাথিউ ২১:৪৩)
আনন্দের সংবাদ হলো, আমরা সেই জাতি – মুসলিম উম্মাহ। এই দায়িত্ব ইহুদীদের থেকে নিয়ে আমাদের উপর অর্পন করা হযেছে। এই মুসলমানদের মাঝে প্রথমে আরব জাতির উপর আল্লাহ তায়ালা দায়িত্ব দিলেন যে তারা দুনিয়ায় জ্ঞান বিজ্ঞানের দিশারী হবে। কিন্তু যখন তারা আরাম করতে শুরু করলো এবং আল্লাহর কাজ আঞ্জাম দিতে ব্যর্থ হলো, আল্লাহ তাদেরকে অপর এক জাতি দ্বারা (জ্ঞান-বিজ্ঞান-মান-মর্যাদায়) বদলে দিলেন। তুর্কীরা ও মঙ্গোলীয়ানরা যখন মুসলিম রাজত্বকে ধ্বংস করে দিলো এবং পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করলো, তখন তারাই হলো এই দুনিয়ায় আলোর দিশারী।

কবি ইকবাল যেমনটা বর্ণনা করেছেন : “হে মুসলমান ! তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে না যদি ইরান অথবা আরব ধ্বংস হয়ে যায়, কারণ মদের মাদকতা তার পাত্রের ধরণের উপর নির্ভর করে না।” এই পাত্র হলো আমাদের জাতিসমূহ, আমাদের সীমানাসমূহ। আর ইসলামের স্পিরিট এসব ভৌগলিক কিংবা জাতিগত সীমাবদ্ধতার উপর নির্ভর করে না। তো, এই কাজটিই আল্লাহ বারবার করেন। তিনি প্রথমে ইহুদীদের পছন্দ করলেন, এবং তারপর আরবদের, তারপর তুর্কিদের এবং তারপর যখন তারাও বেখেয়াল হয়ে গেলো, তখন খ্রিষ্টানরা এসে তাদের উপর চেপে বসলো। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া: যদি আমরা কাজ আঞ্জাম না দিই, আল্লাহ অন্য জাতিকে মনোনীত করবেন।

আমরা গর্ব করে বলি যে বর্তমান পৃথিবীতে এক বিলিয়নের বেশি (১০০ কোটির বেশি) মুসলমান আছে ! আর এই এক বিলিয়ন মানুষের ৯০% হলো সুন্নি ধারার মুসলমান। কিন্তু আমরা আল্লাহর কাজ আঞ্জাম দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি, তাই আল্লাহ তায়ালা এমন একটি জাতিকে মনোনীত করেছেন, যাকে আমরা সবাই উপেক্ষা করে আসছি : ইরানী জাতি! শিয়া!
রানী জাতির উপর অবিচার ছিলো এই যে শাহ ছিলো সেখানকার শাসক। আর এর নাম ছিলো মুহাম্মাদ। কল্পনা করতে পারেন, এই লোকের নাম ছিলো মুহাম্মাদ, অথচ সে আসলে বিশ্বাসীই ছিলো না। আমাদের পক্ষে এটা বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু আপনারা যদি সেদেশে যান আর বিস্তারিত দেখেন কী ঘটেছিলো, তাহলে বুঝতে পারবেন। বুঝতে পারবেন যে, এই শাহ আসলে সেখানে একজন বিদেশী, যদিও সে ফার্সিতে কথা বলতো এবং তার নাম মুহাম্মাদ। হিটলার যদি এই জাতিকে দখল করতো এবং এই জাতিকে নির্যাতন করতো, তাহলে হয়তো আমরা ইরানিদের অবস্থা বুঝতে পারতাম। যদি রাশিয়া দখল করে নিষ্ঠুরতা করতো, তাহলে হয়তো বুঝতে পারতাম। আর এই লোক, সে নামে ইরানি, ফার্সিভাষী, নামটাও আবার মুহাম্মাদ, আর দেখুন সে (শাহ) দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলো ! আমরা এই শাহ আর ইরানকে এক করে দেখে এসেছি এতদিন। আমাদের কাছে তারা একে অপরের সমার্থক। কিন্তু আপনারা যদি বিস্তারিতভাবে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখা যাবে যে, শাহ এবং ইরানি জাতি দুই বিপরীত মেরুতে ছিলো। তারা পরস্পরের কাছে নিতান্তই ভিনদেশীর মত ছিলো।

এখন আসি আমার ইরান ভিজিট এবং ইরান নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গে। শুরু করি সেই জায়গার ঘটনা দিয়ে, যেখানে আমি প্রথম আমাদের ইরানি ভাইদের সংস্পর্শের সুবাস পেলাম। ঘটনাটি ছিলো রোমে। প্রথম অনুভব করলাম আমি, এবং তারপর আমার সঙ্গী-সাথীরাও সেটা দেখলো রোম এয়ারপোর্টে। আমরা (ইরান যাবার) প্লেনে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ভিসা নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছিলো, আমাদের-ই একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো বিষয়টা দেখার জন্য। তো, সে গেলো ইরান এয়ার অফিসে এবং সমস্যাটা খুলে বললো এক কমবয়েসী ভদ্রমহিলাকে – তারা সারা দেহ পরিপূর্ণভাবে ইসলামী পোশাকে আবৃত ছিলো। দেখতেই খুব চমৎকার লাগছিলো। এরকম (ইসলামী) পোষাকে দেখলে তাদেরকে খুব চমৎকার লাগা-ই স্বাভাবিক। তো যা-ই হোক, রোমে আমরা এই চমৎকার মহিলাকে দেখলাম, চশমা পরা – আর আপনারা যদি দেখতেন কী সুন্দরভাবে তিনি সমস্যাগুলোর সমাধান করলেন ! একজন এসে আমাকে বলেছিলো, আরে ভাই আপনি যদি সত্যিকারের মুসলিম ইরানী মেয়ে দেখতে চান তাহলে এদিকে আসেন, দেখে যান ! তখন আমি অন্যান্যদের সাথে গেলাম। ইরানীদের সংস্পর্শে প্রথম আসলাম সেখানে – রোমে।

ইরানে ল্যান্ড করার পর হোটেল ইসতিক্বলাল নামে একটা ফাইভ স্টার হোটেলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো, বিপ্লবের আগে যার নাম ছিলো হিলটন হোটেল। আমাদেরকে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখানো হলো। আমি এর কিছু কিছু আপনাদেরকে বলবো, আর বলার চেষ্টা করবো কী অনুভূতি হয় সেখানে। যদ্দুর মনে পড়ে আমরা প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম বেহেশতে যাহরা কবরস্থানে। ফার্সি শব্দ বেহেশত এর অর্থ হলো জান্নাত, আর যাহরা হলো নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর মেয়ে হযরত ফাতিমা (.) এর উপাধি। যাহরা অর্থ হলো আলোকজ্জ্বল ব্যক্তি। অর্থাৎ জায়গাটার নাম হলো আলোকজ্জ্বল জান্নাত।
ইরানে যাওয়ার আগে আমি আমি বেহেশতে যাহরা কবরস্থান সম্পর্কে পত্রিকায় পড়েছিলাম। পড়েছিলাম যে ইমাম খোমেইনী যখন (১৪ বছরের নির্বাসন শেষে বিজয় সূচিত হবার পর) ইরানের রাজধানী তেহরানে এসে নামলেন, তিনি প্রথমেই গিয়েছিলেন এই কবরস্থানে। আমি ভাবছিলাম, কেনো মানুষ কবরস্থানে যাবে ? দোয়া করার জন্য ? হ্যাঁ বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করার জন্য ? হ্যাঁ। আপনারা যখন কোনো কবরস্থানের কথা চিন্তা করেন, আপনারা ব্রুকস্ট্রিট কিংবা রিভারসাইডের কথা ভাববেন। আপনারা ভাবতেই পারবেন না, এই (বেহেশতে যাহরা) কবরস্থান কয়েক বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। বিশাল খোলা ময়দান – দশ-বিশ লাখ লোক এঁটে যাবে সেখানে। আর মানুষ এখানে আসে কারণ কবরস্থানই হলো আবেগ ও আধ্যাত্মিকতা পুনরুজ্জীবিত করা সবচেয়ে সহজ জায়গা – কারণ সেখানে হলো শহীদদের কবর।
ইরানের বিপ্লবে প্রায় ৭০ হাজারের মত লোক শহীদ হয়েছিলো, আর লক্ষাধিক হয়েছিলো পঙ্গু। নিরস্ত্র মানুষ – তাদের অস্ত্র কেবল "আল্লাহু আকবার” শ্লোগান, এই দিয়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তিকে উল্টে দিয়েছিলো। তো, আমরা সেই গোরস্থানে গেলাম। লক্ষ লক্ষ মানুষ ছিলো সেখানে : নারী, পুরুষ, শিশু...। সেখানে আমাদের মুসলিম ভাইবোনেদের আবেগ এবং নিষ্ঠায় আমরা খুবই অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম। ইরানে তখন শীতের মাঝামাঝি, আর নারী-পুরুষ-শিশু সেখানে ঠান্ডার মধ্যে মাটিতে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ছিলো। চেয়ার নেই কার্পেট নেই – কিচ্ছু না – মাঝ শীতে মাটির উপরে বসে ছিলো তারা। একটা জাতি যারা একভাবে ডিসিপ্লিন মেনে ঘন্টার পর ঘন্টা এই কষ্ট সহ্য করতে পারে – আল্লাহ তাদের জন্য কী সৌভাগ্য দিয়েছেন, তা আপনারা কেবল কল্পনা করতে পারবেন। এক কি দুইদিন পর আমাদের প্রোগ্রামের তালিকায় আবার দেখলাম বেহেশতে যাহরার নাম। প্রথমবার আমরা একটা লেকচার শুনতে গিয়েছিলাম, আর মানুষকে দেখেছিলাম দোয়া করতে, বিষাদের কবিতা পড়তে – আমি ভাবলাম দ্বিতীয়বার গিয়ে আর লাভ কী ! দ্বিতীয়বার কেনো যাবো ? কবরস্থান কী, তা তো দেখলামই। কিন্তু আমার সফরসঙ্গী সবাই-ই যাচ্ছিলেন। আমি ভাবলাম, বাকি সবাই-ই যখন যাচ্ছে, আমি হোটেলে বসে আরাম করবো – এটা ভালো দেখায় না। তাই আমি গেলাম, এবং আমি খুব খুশি হলাম।
দ্বিতীয়বার যখন আমি (বেহেশতে যাহরায়) গেলাম, সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। ইরানে বৃহস্পতিবার হলো আমাদের এখানের শনিবারের মত (অর্থাৎ ছুটির দিন)আর সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছিলো। এটা সেখানকার রীতি। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয় – কল্পনা করতে পারবেন না, আমার কাছে ঈদের মত মনে হলো। যেনো এক ইদগাহ, কিন্তু আমাদের ইদগাহ সেটার তুলনায় কিছুই না। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেখানে, কিন্তু কীসের জন্য ? তাদের আধ্যাত্মিকতাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য। এ যেন এক সার্বক্ষণিক রিমাইন্ডার – "আমার ছেলে ইসলামের জন্য তার জীবন দিয়েছে” কিংবা "আমার বাবা-ভাই ইসলামের জন্য জীবন দিয়েছে”। এইরকম এক সিস্টেমে প্রতি বৃহস্পতিবারই হলো আধ্যাত্মিক ইনজেকশানের মত, রিমাইন্ডারের মত, যে তারা ইসলামের জন্য নিজেদের জীবন দিয়েছিলো।

সেখানে (ইরানে) প্রায় ১৬ হাজার লোকের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটা টাউনহল ছিলো। তুলনা করতে গেলে, সাউথ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় হল কেপটাউনের গুড হোপ সেন্টার এর ধারণক্ষমতা ৮ হাজার মাত্র। যাহোক, সেই টাউনহল তৈরী করেছিলো ইরানের শাহ, তার নিজের "আর্য গৌরব” দেখানোর জন্য। সে শুধুমাত্র শাহানশাহ (রাজাধিরাজ – রাজাদের রাজা) হবার গর্বই করতো না, আরো গর্ব করতো যে সে আর্য বংশোদ্ভূত। এই অসুস্থ "আর্-গৌরব" জিনিসটা কী? স্মরণ করুন, হিটলার নিজেকে আর্য বলে গর্ব করতো, কারণ জার্মানরা আর্য ছিলো। আবার হিন্দুরা নিজেদের আর্য বলে গর্ব করে। যদি আমার গুজরাটি পূর্বপূরুষেরা মুসলমান না হতো, তাহলে আমরাও নিজেদের আর্য বলে গর্ব করতাম। যাহোক, আর্য-গৌরবের চিহ্ন হিসেবে শাহ এই টাউনহল বানিয়েছিলো। এরকম সে আরও বানিয়েছিলো, জাতীয় অর্থ অপচয় করে, নিজের পূর্বপূরুষ সাইরাস দ্য গ্রেট, এক মুশরিক মূর্তিপূজারীর স্মরণে। ১৯৮৪ সালে (ইরানের রাজধানী) তেহরানে তার অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত করার কথা ছিলো। যাহোক, এই টাউনহলে আমরা অ্যাথলেটিকস দেখলাম, দেখলাম জিমন্যাস্টিকস, অ্যাক্রোব্যাটিকস। দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সাউথ আফ্রিকার মুসলমানেরা জেলীফিশের মত। আমাদের যুবকেরা এজাতীয় কাজে (জিমন্যাস্টিকস, ইত্যাদিতে) অংশগ্রহণ করে না। কে করে অ্যাথলেটিকস, জিমন্যাস্টিকস, অ্যাক্রোব্যাটিকস ! কে করে কারাতে ! মরা এসব করি না। এসব আমাদের জন্য না। এসব অন্য জাতির জন্য। কে করে জগিং ! এসব অন্য জাতির জন্য।
দেখুন, এখানের যুবকদের সাথে আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়, আমি তাদের সাথে হ্যান্ডশেইক করি – এরা যেনো জেলীফিশ ! আর ইরানের প্রত্যেকটা যুবককে মনে হবে অ্যাথলেটের মত। তাদের সাথে হ্যান্ডশেইক করলে মনে হবে যে হ্যা, মানুষের সাথে হ্যান্ডশেইক করছি, জেলিফিশের সাথে না (দর্শকের হাসি) তারা আন্তর্জাতিক মানের স্পোর্টসে অংশ নিচ্ছে। আর একটা জিনিস দেখে ভালো লাগে, তারা "ইরানকে" তুলে ধরে না। তারা বলে না যে : “আমরা ইরানি”। বরং তারা ইসলামকে তুলে ধরে, ইসলামের কথা বলে, ইসলামের কথাই বলে। সেখানে একটাও না – একটিও অর্ধ নগ্ন মেয়ে ছিলো না। আর যদি শাহ বেঁচে থাকত আর এই স্পোর্টস অর্গানাইজ করতো, তাহলে এই সুন্দর চাদর পরা মেয়েদেরকেই অর্ধনগ্ন করে রাখা হতো সবার দেখার জন্য, ভোগ করার জন্য।

(ইসলামী) ইরানে সবকিছুই ইসলামিক, যেনো দেশের জনগণের নৈতিকতা উন্নত হয়। আমরা থ্রিলড হয়েছি, থ্রিলড হয়েছি সেখানের শিশুদের দেখে, মনে হয়েছে যেনো তারা আমাদেরই, আমাদের নিজেদেরই ভাই-বোন। আমরা সত্যিই বিমোহিত হয়েছি।
তারপর আমরা ইরানী বিভিন্ন গ্রুপের মিলিটারি প্যারেড দেখলাম – তাদের জনশক্তির কোনো অভাব ছিলো না। আপনারা জানেন, কেউ কেউ চায় ইরানে গিয়ে সেখানে আমাদের ভাইদের সাহায্য করতে। আলহামদুলিল্লাহ, তাদের জনশক্তির কোনো অভাব নাই। তাদের এখন শুধু দরকার যন্ত্রপাতি, (দেশরক্ষার) অস্ত্রশস্ত্র। ইরানের যদি ইসরাঈলের মত মিলিটারি অস্ত্রশস্ত্র থাকতো, তাহলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য সবধরণের বহিঃশক্তির অনুপ্রবেশ থেকে মুহুর্তের মধ্যে মুক্তি পেত। এই (ইরানি) জাতিই সেটা করতে পারে। তাদের মাঝে সেই স্পিরিট আছে, জিহাদের স্পিরিট আছে তাদের প্রত্যেকটা নারী-পুরুষের মাঝে। মনে হয় যেন তাদের গোটা জাতিটাই ইসলামকে প্রমোট করতে ব্যস্ত। তাদের যদি সেই অস্ত্র এবং রসদ থাকতো, তাহলে তারা ২০ মিলিয়ন মানুষকেই ময়দানে নামাতে পারতো। মনে হয় প্রত্যেকটা নারী-পুরুষ-শিশু এগিয়ে যেত জিহাদে।

এরপর আমরা ইরাকি যুদ্ধবন্দীদের দেখতে গেলাম। আপনারা তো জানেন ইরানে ইরাকের আক্রমণের ঘটনা। (বিপ্লবের পরপর) গোটা দেশটাই দুর্দশাগ্রস্ত ছিলো। ইরাক (সাদ্দাম হোসেন) মনে করলো যে, ইহুদিরা যদি আরবদের ৬ দিনে পরাজিত করতে পারে (ফিলিস্তিন দখল করে ইসরাঈল প্রতিষ্ঠা করতে পারে), তাহলে আমরা ইরানিদেরকে ৩ দিনে পরাজিত করবো। গোটা বিশ্ব ভেবেছিলো যে এক সপ্তাহের মধ্যে ইরান টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। কিন্তু আপনারা জানেন তারা কতদিন যুদ্ধ করছে ? প্রায় দেড় বছর যাবৎ তারা ইরাকের সাথে এখনও যুদ্ধ করছে। (পাশ্চাত্য নিয়ন্ত্রিত ও সমর্থিত সাদ্দাম হোসেন ১৯৮০ সালে শিশুরাষ্ট্র ইরানে আক্রমণ করে এবং পরবর্তীতে প্রায় আট বছর এ যুদ্ধ চলে। এরপর একটি চুক্তির মাধ্যমে এ যুদ্ধের অবসান ঘটে। – অনুবাদক) তাদের বিজয় ছিলো বিশে এক, এবং তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে সেটাতে তিনে-এক এ নিয়ে আসলো। এবং তারা ইরাকিদের পিছু হঠাতে সক্ষম হলো। তারা নিজেদের জমি, পাহাড় ইত্যাদি পুনর্দখল করলো। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য আরো সময় দিন।

যুদ্ধক্ষেত্র ভিজিট করার আগে ব্রিটেনের ড. কালিম সিদ্দিকী মজা করে বলেছিলেন, ভাই, আপনাদের শহীদ হওয়ার অর্ধেক সুযোগ আছে। উনি কৌতুক করে বলেছিলেন, কিন্তু সেটা প্রায় সত্যই হয়ে গিয়েছিলো। ইরাক থেকে পুনরুদ্ধার করা বিধ্বস্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে (ভিজিট শেষে) বের হয়ে আসার সময় একটা মাঠ পার হচ্ছিলাম, সেখানে অনেক ট্যাংক রাখা ছিলো। আমার যুবক সফরসঙ্গীরা বাস থেকে নেমে ট্যাঙ্কে উঠে ছবি তোলা শুরু করলো, যেনো বাড়ি ফিরে লোকজনকে দেখাতে পারে। তখন হঠাৎ একটা ট্রেনিং ট্যাংক ডেমোনস্ট্রেট করার জন্য এগিয়ে এলো, হঠাৎ আমরা গুলির শব্দ শুনলাম, দূর থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখলাম, আর আমাদের লোকজন ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ঝোপের আড়ালে লুকানো শুরু করলো। আমরা আসলে ইরাকি আক্রমণের মধ্যে পড়েছিলাম ! আমাদের চারিদিকে বোমা বিস্ফোরিত হচ্ছিলো (ইরাকি বোমারু বিমানের গোলাবর্ষণ থেকে), তবে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করলেন। অর্ধেক চান্স না, আমাদের শহীদ হওয়ার প্রায় ফুল চান্স-ই এসে গিয়েছিলো (হাসি)
(রান-ইরাক যুদ্ধের সময়ে আমেরিকার আরোপিত অবরোধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ইরান যুদ্ধসামগ্রী কিনতে পারত না। এছাড়াও সেসময়ে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখনকার মত উন্নত ছিলো না, প্রায়ই ইরাকি বোমারু বিমান ইরানের অভ্যন্তরে বহুদূর পর্যন্ত ঢুকে পড়তো। – অনুবাদক।)

আমরা যুদ্ধাহতদের দেখতে গিয়েছিলাম, এবং তাদের কেউ-ই কোনো অভিযোগ করছিলনা তাদের দুরবস্থার ব্যাপারে। এক লোকের পা কেটে ফেলা হয়েছিলো, কিন্তু তার চোখে কোনো অশ্রু ছিলো না। একজনও না – আমি তাদের একজনের চোখেও অশ্রু দেখিনি। বরং তারা বলছিলো যে তাদের পক্ষে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যাওয়া সম্ভব কিনা। তারা তাদের দেহের ক্ষতের জন্য অনুতাপ করছিলো না, তারা অনুতাপ করছিলো যে কেনো তারা যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যেতে পারছে না, কেনো তারা আবার যুদ্ধ করে শহীদ হতে পারছে না। তার অনুতাপ ছিলো যে কেনো সে শহীদ হলো না ! সেখানকার প্রতিটা মুসলমানের লক্ষ্য এটাই।

যখন সেখানের ইরাকি যুদ্ধবন্দীদের দেখতে গেলাম, প্রায় ৭ হাজার আটশ যুদ্ধবন্দী, তাদের সবাাইকেই ভালো দেখাচ্ছিলো। ভালো পোষাক পরা, সুস্থ মানুষ। আমার এক বন্ধুর আগ্রহ হলো ইরাকি বন্দীদের থেকে সরাসরি তাদের অনুভূতি জানতে চাইবে। তাকে সুযোগ দেয়া হলো যে কারো সাথে কথা বলে জিজ্ঞাসা করার। যাদেরকেই সে জিজ্ঞাসা করেছিলো, সবাই-ই বলেছে যে তাদেরকে যথাযথভাবে দেখাশোনা করা হচ্ছে। তখন আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। এই বন্দীদের কারো কারো এক বছর হয়েছে (বন্দীত্বের), কারো বা কয়েক মাস। আমি ভাবলাম, এদের মাঝে কতজন সুইসাইড করেছে ? আমি যুদ্ধবন্দী প্রত্যেকটা গ্রুপকে জিজ্ঞাসা করলাম, এবং প্রত্যেকেই জবাব দিলো : একজনও নয়। একজনও না – সাত হাজার আটশ' যুদ্ধবন্দীর মাঝে একজনও সুইসাইড করেনি ! আর আমি যদি আমাদের সাউথ আফ্রিকার তথাকথিত ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজড দেশের দিকে তাকাই : আমাদের জেলে ৪৬ জন সুইসাইড করেছে শুধুমাত্র এই বছরেই ! অথচ তারা ভালো খায়, পরে এমনকি থাকার জন্য সবার নিজস্ব সেল আছে। তারপরও ৪৬ জন সুইসাইড করেছে ! মানুষ যদি ভালো ব্যবহার না পায়, নির্যাতনের মধ্যে থাকে, তাহলে অন্য কোনো পন্থা খুঁজে নেয়, সুইসাইড করে। কিন্তু (ইরানে) সাত হাজার আটশ (ইরাকি) যুদ্ধবন্দীর একজনও সুইসাইড করেনি !

মরা ইমামের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভি আল খোমেইনী। আমরা প্রায় চল্লিশজনের মত ছিলাম। আমরা ইমামের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ইমাম এলেন, তার থেকে দশ মিটার মত দূরে ছিলাম আমি; আমি ইমামকে দেখলাম। তিনি আমাদেরকে প্রায় আধাঘন্টার একটি লেকচার দিলেন, আর কুরআনের বাইরে এতে কিছু ছিলো না। এই মানুষটা যেনো কম্পিউটারাইজড এক কুরআন। আর তিনি যখন পাশের একটা রুম থেকে হেঁটে এসে ভিতরে ঢুকলেন, সবার উপর তাঁর যে প্রভাব (আহমদ দীদাত এখানে “electric effect” কথাটি ব্যবহার করেছেন – অনুবাদক।), তাঁর যে কারিশমা – বিস্ময়কর ! তাঁর দিকে তাকানোর সাথে সাথে কোনো ভাবনা ছাড়াই চোখের কোল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আপনি তাঁর দিকে তাকান : আপনারচোখ অশ্রুসজল হয়ে যাবে। এর চেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম মানুষ আমি জীবনে কখনো দেখি নাই। কোনো ছবি, ভিডিও বা টিভি তাঁকে উপযুক্তভাবে তুলে ধরতে পারবে না : আমার সারা জীবনে দেখা সবচে' হ্যান্ডসাম মানুষ হলেন তিনি। (“No picture, no video, no TV could do justice to this man, the handsomest old man I ever saw in my life was this man, Imam Khomeini.” – Ahmed Deedat)
াঁর নামেরও কিছু ইউনিক ব্যাপার আছে। প্রথমত, তাঁকে বলা হয় ইমাম খোমেইনী। আমাদের কাছে "ইমাম” খুবই সস্তা একটি শব্দ। আমরা কোথাও গেলেই জিজ্ঞাসা করি, এই মসজিদের ইমাম কে, ইত্যাদি। শিয়াদের কাছে এই দুনিয়ায় ইমাম বলতে শুধু একজনকেই বুঝায় যার জন্য তারা অপেক্ষা করছে – আর তিনি হলেন বারোতম ইমাম। তারা ইমামতের ধারণায় বিশ্বাসী; এই ধারণা অনুযায়ী ইমাম হলেন উম্মাহর আধ্যাত্মিক নেতা। ইমামতের ধারা অনুযায়ী প্রথম ইমাম হলে হযরত আলী (রা.)। তারপর দ্বিতীয় ইমাম, ইমাম হাসান, এরপর ইমাম হুসেইন, তৃতীয় ইমাম এভাবে বারোতম ইমাম, ইমাম মুহাম্মাদ, যার পাঁচ বছর বয়সে তিরোধান হয়েছিলো, এবং তারা তাঁর প্রত্যাবর্তনের আশা করে আছে। তাঁর ক্ষেত্রে ইরানিরা অকালটেশান (occultation) শব্দটা ব্যবহার করে, এক প্রকার আধ্যাত্মিক ঘুমের মত ব্যাপার বুঝাতে, অনেকটা আসহাবে কাহাফের মত। তিনি একসময় ফিরে আসবেন, এবং ইমাম শব্দটা একমাত্র তাঁর জন্যই। তাদের (শিয়াদের) বেশিরভাগ (ধর্মীয়) স্কলারদের মোল্লা বলা হয়, আর আয়াতুল্লাহ অর্থ হলো আল্লামা। তবুও ইমাম খোমেইনীকে তারা ইমাম বলে ! যেকোনোভাবেই হোক, গোটা জাতি এটাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। ইমাম খোমেইনীকে তারা ইমাম বলে সম্মান থেকে, কিন্তু তারা প্রকৃত ইমামের আসার অপেক্ষায় আছে।
রুহুল্লাহ নামটি তাঁর বাবা রেখেছিলেন। এর অর্থ জানেন ? রুহুল্লাহ অর্থ আল্লাহর স্পিরিট, আর কুরআনে এই শব্দটা ঈসা (.) এর উপাধি। এরপর তিনি আয়াতুল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহর চিহ্ন, যেটা কুরআনে ঈসা (.) এর অপর উপাধি। তো, তিনি হলেন আয়াতুল্লাহ – আল্লাহর চিহ্ন, রুহুল্লাহ – আল্লাহর স্পিরিট, আল মুসাভি – মুসা (.) এর বংশধর, আল খোমেইনী – ইরানের খোমেইন প্রদেশ থেকে। তাঁকে তারা (ইরানি জাতি) ইমাম হিসেবে গ্রহণ করেছে। এবং তিনি জিহাদ ঘোষণা করেছেন, আর গোটা জাতি তাঁর এই জিহাদের ডাকে সাড়া দিয়েছে।

(উল্লেখ্য, ইমাম খোমেনির নামের মুসাভি শব্দটি এসেছে বংশীয় নাম হিসেবে। এর অর্থ মহান নবী হযরত মুসা (আ.) এর বংশধর নন। বরং তিনি ছিলেন শিয়াদের অষ্টম ইমাম ও নবী-বংশের সদস্য ইমাম মুসা রেজা (.) এর বংশধর। ইমাম রেজা (.) এর বাবা সপ্তম ইমাম ছিলেন ইমাম মুসা কাজিম (.)। ইনারা ছিলেন খলিফা হারুন ও মামুনের সমসাময়িক। – অনুবাদক)

তো, যেই ইমামের জন্য তারা অপেক্ষা করছে, তিনি খোমেইনী নন। তারা (শিয়ারা) দুনিয়ায় ইমাম মাহদী আসার পরিবেশ তৈরী করছে, তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা সুন্নিরাও ইমাম মাহদীর আগমনের অপেক্ষায় আছি কিন্তু আমরা চাই তিনি কষ্ট করে, পরিশ্রম করে দুনিয়াকে (ইসলাম দিয়ে) জয় করে আমাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন, গোটা দুনিয়ার উপর নেতা হওয়ার সুযোগ করে দেবেন। সুন্নিরা কেবল অপেক্ষা করে আছে। ততদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের তুচ্ছ ঝগড়া-বিবাদ চালিয়ে যেতে পারি, যা আমরা বর্তমানে করছি। আর কেবল ইমাম মাহদীই পারেন আমাদের জন্য দুনিয়াটাকে সহজ করে দিতে। এটা হলো সুন্নি ধারার চিন্তা।
অপরদিকে, ইমাম খোমেইনী তাঁর অনুসারীদের বলছেন যে, আমাদের অবশ্যই ইমাম মাহদীর আগমনের রাস্তা তৈরী করতে হবে, যেন তিনি এসে সবকিছু প্রস্তুত পান। যখন আমরা সুন্নিরা অপেক্ষায় আছি যে ইমাম মাহদী এসে আমাদের জন্য সমস্ত কষ্ট করবেন, শিয়ারা তাঁর আগমনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। তো, ইমাম খোমেইনী মারা গেলেও, তাদের আদর্শ রয়ে যাচ্ছে, সেটা হলো ইমাম মাহদীর আগমন।

আমাদের সেই সফরে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষ ছিলো। আমি বিভিন্ন ধরণের বিকৃত মানসিকতার মানুষ দেখেছি। এক পাকিস্তানি আলেম, “মওলানা সাহেব” এর সাথে দেখা হয়েছিলো। তিনি বললেন যে এই শিয়াদের মাঝে বড় রকমের সমস্যা আছে। ইরানে যখন কেউ কোনো লেকচার দিতে থাকে, তখন প্রতিবার "খোমেইনী” নামটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে সব মানুষ থেমে যায় এবং রাসূলের উপর তিনবার দরূদ পড়ে। কিন্তু মুহাম্মাদ নামটা উচ্চারণ করলে তারা দরূদ পড়ে একবার। নবীজির নাম উচ্চারিত হলে একবার দরূদ, আর ইমাম খোমেইনীর নাম উচ্চারিত হলে তিনবার দরূদ। তো, এই মৌলভি সাহেব বললেন : “দেখো এদের কারবার ! কেমন মুসলমান এরা ? যখন মুহাম্মাদ (সা.) এর নাম উচ্চারণ করা হয় তারা মুহাম্মাদের উপর একবার দরূদ পাঠ করে, কিন্তু যখন খোমেইনী নামটা উচ্চারণ করা হয় তখন তারা *খোমেইনীর* উপর তিনবার দরূপ পাঠ করে।
আমি মৌলভী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তারা কী বলে ? এইযে "খোমেইনীর উপর দরূদ” – সেখানে তারা কী বলে ? এইযে "আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ, ওয়া আলি মুহাম্মাদ” – কে মুহাম্মাদ ? খোমেইনী ? কে তার নাম মুহাম্মাদ রাখলো ?”
কল্পনা করতে পারেন তাদের মানসিক অসুস্থতা ! এত পড়াশুনা করা মানুষ, অথচ তার দৃষ্টিভঙ্গি কতটা একপেশে, অহংকারী। তারা শুধু দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আরেকটা উদাহরণ হলো, শিয়া ভাইয়েরা নামাজ পড়ার সময় তাদের সাথে রাখা এক টুকরা মাটির উপর সেজদা দেয়। তিনি বললেন : “দেখুন তারা কী করে। তারা তো শিরক করছে। তারা মাটির টুকরাকে পূজা করছে।”
বললাম, “আপনি গিয়ে নিজেই তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন না কেনো ? বলেন যে ভাই কেনো তোমরা এক টুকরা মাটির উপর সেজদা করছো ? প্রশ্ন করে এর পিছনে লজিক কী, সেটা জেনে নিন !”
প্রথম আমি এই জিনিসটি দেখি ওয়াশিংটন ডিসিতে। সেখানকার ইরানী ছাত্ররা তাদের ইউনিভার্সিটিতে আমাকে একটা লেকচার দিতে আমন্ত্রণ জানালো। তখন এশার ওয়াক্ত হয়েছে, আমরা সবাই নামাজ পড়লাম। সবাইকে একটি করে মাটির টুকরা দেওয়া হলো। আপনারা যা করতেন, তখন আমার কাছেও ব্যাপারটা হাস্যকর লেগেছিলো, তাই আমি ওটাকে পাশে সরিয়ে রেখেই ইরানী ছাত্রদের সাথে নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষে আমি বিষয়টা জানতে চাইলাম এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম : “তোমরা যেখানেই যাও সেখানেই পকেটে এই মাটির টুকরা নিয়ে যাও কেনো ?” তারা বললো, এই কাজের পিছনে লজিক হচ্ছে যে : “আমাদের আল্লাহর ভূমিতে সেজদা করার কথা, যেখানে আমাদের কপাল স্পর্শ করবে মাটি। আমাদের কপাল মাটিতে স্পর্শ করিয়ে আমরা তিনবার সুবহানা রাব্বিয়াল আলা বলি।” আমি বললাম, এতে তো কোন সমস্যা নেই। তো, শিয়ারা আসলে মাটিতে সেজদা করতে চায়, মানুষের তৈরী কার্পেটে নয়। মাটিতে কপাল স্পর্শ করার মাধ্যমে তারা তাদের নিবেদনে (নামাজে) আরো খাঁটি হতে চায়। তাদেরকে ছোটবেলা থেকে বলা হয়েছে যে তোমাকে মাটিতে কপাল স্পর্শ করাতে হবে; আর কারবালার মাটির চেয়ে কোন মাটি বেশি খাঁটি হতে পারে !
(ইরানিরা কারবালার মাটির টুকরা ব্যবহার করে সেজদার জন্য। – অনুবাদক।) দেখুন, তারা মাটিকে পূজা করে না – তাদের লজিকটা দেখুন ! অথচ এই বিষয় নিয়ে আমরা (সুন্নিরা) সবসময় শিয়াদের উপহাস করেছি

তেহরান থেকে ফেরার পথে প্লেনে দুইজন শিয়াকে দেখলাম, তাদের একজন পকেট থেকে রুমাল বের করলো, তার ভাঁজের ভিতরে মাটির একটি টুকরা রাখা। "আল্লাহু আকবার !” – সে নামাজ পড়তে শুরু করলো। আমরা যেমন অনেকে মসজিদে বসে বসে নামাজ পড়ি, সে প্লেনের সিটে বসে সেটা করছিলো। তারপর তার নামাজ শেষ হলে পাশেরজনকে দিলো, এবং সে নামাজ পড়লো। আমাদের কাছে এটাকে হাস্যকর মনে হতে পারে, তাই না ? কিন্তু ভেবে দেখুন, সেই প্লেনে প্রায় বারোজন সুন্নি ছিলো অথচ তাদের মাঝে মাত্র একজন নামাজ পড়লো। না, সেটা আমি ছিলাম না। কিন্তু আমরা অন্যদের নিয়ে উপহাস করছি ! ঐখানে বসে বসে সেই শিয়া আমাদের চেয়ে ভালো একটি কাজ করছে, অথচ আমরা বিচারক সেজে বসে তাদের নিয়ে উপহাস তামাশা করছি।

আপনারা জানেন কিনা জানি না – সুন্নিদের চারটি মাযহাব – হানাফী, হাম্বলী, মালেকী, শাফেয়ী – এই চারটি মাযহাবের মধ্যে কেবল নামাজেরই দুইশ'র অধিক পার্থক্য আছে। আগে জানতেন এটা ? দুই শত। কিন্তু আমরা এটাকে আমলে নেই না। শাফেয়ী মাযহাবের লোকেরা জোরে আমিন বলে, আমরা বলি নীরবে। তারা বিসমিল্লাহ জোরে বলে, আমরা বলি নীরবে। কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা নেই।
আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার বাবা প্রায়ই একটি ফর্মুলা বলতেন, যা তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন : “সব মাযহাবই সমানভাবে বৈধ, আর তাদের মাঝে সত্য হলো হাদিস ও কুরআন।” এবং আমরাও তা-ই মনে করি। যখন শাফেয়ী, হাম্বলী, হানাফী, মালেকীর প্রশ্ন আসে, আমরা তাদের ব্যাপারে সহনশীল। কিন্তু যখন শিয়াদের কথা ওঠে – "তারা বাতিল !” কারণ আমাদের সেভাবেই শিখানো হয়েছে ! সুতরাং আমাদের সাথে তাদের যেকোনো রকম পার্থক্যই থাকুক না কেনো, আমরা সেটা সহ্য করতে পারি না ! অথচ আমরা হাম্বলী, মালেকি, হানাফি, শাফেয়ী – এদের মাঝের দুইশ পার্থক্য মেনে নেই !

আমি বলি, শিয়া ভাইদেরকে আমরা পঞ্চম মাযহাব হিসেবে গ্রহণ করি না কেনো ! আর বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, তারা (শিয়ারা) বলে যে তারা আমাদেরই একজন হতে চায়। তারা কিন্তু আমাদেরকে শিয়া হওয়ার কথা বলছে না। বরং তারা বলে : "শিয়া-সুন্নি কিছু নাই, একটি জিনিসই আছে, আর তা হলো ইসলাম।" কিন্তু জবাবে আমরা তাদেরকে বলি : “না। তোমরা আলাদা। তোমরা শিয়া।” দেখুন, এই দৃষ্টিভঙ্গিটা শয়তানের তৈরী বিকৃতি। শয়তান আমাদেরকে বিভক্ত করতে চায়। ভাবতে পারেন, আমরা সুন্নিরা মুসলিম জনসংখ্যার ৯০%। আর বাকি ১০%, যারা কিনা শিয়া, তারা আমাদের দ্বীনি সঙ্গী হতে চায়, কিন্তু এই বাকি ৯০% তাতে ভীত ! আমার এটা বুঝে আসে না, কেনো ৯০% এর এই আমরা ভীত হবো ‍! বরং তাদের ভীত হওয়া উচিত ! (এই অর্থে যে, তারা শিয়ারা সংখ্যায় কম, সুতরাং ৯০% এর সাথে মিশলে তাদের চিন্তাধারা বদলে যাবে এবং তারাও অধিকাংশের প্রভাবে সেই ৯০%, অর্থাৎ সুন্নিদের মতই হয়ে যাবে। – অনুবাদক।) কিন্তু আমরা ভীত ! আমার কথা হলো, আমরা ভয় পাবো কেনো ?

আপনারা যদি শুধু জানতেন আমাদের (সুন্নিদের) জন্য তাদের কী অনুভূতি ! রানে জুমার নামাজে লক্ষ লক্ষ মানুষ জমায়েত হয়। আপনাদের নিজে গিয়ে দেখা উচিত – যখন আপনি তাদের পাশ দিয়ে যাবেন আর তারা দেখবে যে আপনি ভিনদেশী (কিন্তু মুসলিম), তাদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে পড়বে। আমাদের (সুন্নিদের) প্রতি তাদের অনুভূতি এমনই। কিন্তু আমরা বলি : “না, আমরা তাদেরকে (উম্মাহর) বাইরে রাখতে চাই (এই ভয়ে যে যদি আমরা তাদের মত হয়ে যাই)” আপনি কেবল তখনই বদলে গিয়ে তাদের মত হবেন, যখন তাদের কাছে আপনার চেয়ে উত্তম জিনিস আছে। (“You can only be absorbed if they are something better than what you have.” – Ahmed Deedat)
[মানুষ খারাপের সংস্পর্শে আসলেও বদলে যায়, এবং সেকারণে অনেকে সতর্কতাবশতঃ খারাপ থেকে দূরে থাকে। (উত্তম অধমের সাথে চলে নিশ্চিন্তে, সে-ই মধ্য যে চলে তফাতে।) আবার, যাদের অন্তরে সত্যের দিকে ঝোঁক আছে, তারা অধিকতর সত্যের সন্ধান পেলে সেইদিকে ঝুঁকে পড়ে, বদলে যায়। একারণ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যখন ইসলাম প্রচার করছিলেন, তখন কাফিরদের একটি দল মানুষকে এমনকি কুরআনের বাণী শুনতেই নিষেধ করতো, কারণ এর বাণী শোনামাত্রই সত্যপ্রিয় মানুষের বদলে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করার আশঙ্কা (!) ছিলো, আছে। আহমদ দীদাত এখানে দ্বিতীয় প্রেক্ষাপটের কথা বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ সুন্নি সত্যপন্থী মুসলমানেরা শিয়া মুসলমানদের মাঝে কোনো কোনো বিষয়ে অধিক সত্যের সন্ধান পেলে বদলে গিয়ে সেগুলোকে গ্রহণ করবে। সুন্নি মুসলমানদের মাঝে যারা বিভেদ জিইয়ে রাখতে চান কিংবা নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি দূর করতে অনাগ্রহী, তারা এই ভয়েই শিয়াদেরকে প্রত্যাখ্যান করছেন। – অনুবাদক।]

ানি না আপনাদের কেউ কেউ আমাকে শিয়া ভাবছেন কিনা (হাসি), আমি কিন্তু আপনাদের সাথেই আছি। এইসব শিয়া-সুন্নি আবার কী ? এগুলো সব পলিটিক্স। আমাদের এই শত্রুতা – এগুলো সব পলিটিক্স।
শিয়াদের মাঝে নানা রকম শিয়া আছে। সুন্নিদের মাঝে নানা রকম সুন্নি আছে। আমাদের অনেকে আছে যারা কবরস্থানে গিয়ে সেজদা করে, করে না ? আপনি কি বলবেন যে সে কাফির ? যদি আপনার বাবা কিংবা দাদা হতো, আপনি বলতেন : “আল্লাহ মাফ করুন, সে ভুল পথে যাচ্ছে।” কেনো ? কারণ সে আপনার বাবা, আপনার চাচা। কিন্তু যদি কোনো শিয়া কোথাও কোনো ভুল করে, আমরা গোটা শিয়া কমিউনিটিকেই দোষারোপ করি। বলি, এই সাড়ে তিন কোটি মানুষ, এরা সব রাবিশ !
(আবার,) এক গ্রুপ সুন্নি অপর গ্রুপকে বলে : “তোমরা মুসলমান না”, আবার সুন্নিদের আরেক গ্রুপ বলে : “তোমরা মুসলমান না, তোমরা কাফির, তোমরা বিদআতী”। দেখুন, এটা আমাদের নিজেদের ভিতরে ঘটছে, আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছি।

আমাদের এক খুব শিক্ষিত ভাইয়ের সাথে একবার সাক্ষাৎ হলো, তিনি আমাকে বললেন যে আপনি যদি নিউ কাসল এ যান, ওমুক ওমুকের সাথে দেখা করবেন, ইন-শা-আল্লাহ আপনার যত্ন-আত্তি করবে তারা। তো, কথামতো আমি সেখানে গেলাম। আমাকে খাবার জন্য সে ঘরে নিয়ে গেলো। যখন আমি টেবিলে বসে ছিলাম, আমি দেয়ালে "বোরাক" এর ছবি দেখলাম। "বোরাক" কী জানেন ? গাধার মত দেখতে একটা প্রাণী, আর সেখানে মহিলার চেহারা। সে টেবিলে আসলে আমি বললাম, “য়ে কেয়া হ্যায় ?” বললাম, দেখো, এটা ঠিক না। দেখো, বোরাক অর্থ ইলেকট্রিসিটি। আল্লাহ বোরাক সৃষ্টি করেছেন। তুমি এটাকে গাধার ছবিতে মহিলার মাথা দিয়ে তৈরী করতে পারো না। সে খুবই দুঃখিত হলো। কিন্তু সে একজন সুন্নি ! সে আমার (দ্বীনি) ভাই, এবং এখনও সে আমার ভাই। এই শিয়া-সুন্নি বিভেদটা শয়তানের কাজ, আমাদেরকে বিভক্ত করার জন্য।

ভাইয়েরা, ইরান সম্পর্কে আরেকটা কথা বলি। আমি যা দেখলাম তা হলো, সেখানে সবকিছু ইসলামমুখী। গোটা জাতিই ইসলামের দিকে চলছে। আর তারা কেবল কুরআন নিয়েই কথা বলছে। আমি একজনও ইরানিকে দেখিনি যে, যখন আমি কোরআনের কোনো কথা বলেছি, আমার বিরোধিতা করেছে। অথচ আমাদের আরব ভাইয়েরা, তাদের কাছে কোরআন থেকে কোট (উদ্ধৃত) করেন, ারা আপনাকে কোরআন দিয়ে বিরোধিতা করবে। তারা আরব, আমাদের চেয়ে কুরআন তাদের ভালো জানার কথা, কিন্তু এই ইরানিদেরকেই দেখলে মনে হয়, তারাই কুরআনের সাথে সমান পথে আছে। তারা যা করছে, যা চিন্তা করছে, সবই কুরআন।

পনাদের তাবাস মরুভূমির কথা মনে আছে ? যখন আমেরিকা তার বন্দীদের মুক্ত করতে গেলো।
(১৯৭৯ সালের বিপ্লবের সময়ে ইরানের কয়েকজন ইউনিভার্সিটি ছাত্র মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করেন এবং তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্রের দলিল উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে সেগুলো তাদের মিডিয়াতে প্রচার করা হয়। আর সেসময়ে মার্কিন দূতাবাসের কর্মচারীদের বন্দী করে রাখা হয়েছিলো, যাদেরকে উদ্ধারের জন্য ইসলামি ইরানের সাথে অনেক নেগোসিয়েশান করে ব্যর্থ হবার পর কার্টার প্রশাসন অবশেষে কমান্ডো হেলিকপ্টার পাঠিয়ে তাদেরকে উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মাঝে মরুভূমিতে মাঝপথেই কিছু হেলিকপ্টার নেমে পড়তে বাধ্য হয়, আর সর্বশেষ হেলিকপ্টারটি তাবাস মরুভূমিতে রাডার এড়াতে গিয়ে নিচু দিয়ে ওড়ার সময় মরুঝড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হয়। – অনুবাদক।)
আমেরিকা – দুনিয়ায় টেকনোলজিতে অগ্রসর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ – এমন এক দেশ যে কিনা চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে আবার ফেরত আনতে পারে, যারা বলতে পারে চাঁদের কোন জায়গায় গিয়ে তারা ল্যান্ড করবে, যারা মঙ্গল আর বৃহস্পতি গ্রহে অনুসন্ধানী মেশিন পাঠায় – তারা কিনা ইরানে পা ফেলতে পারলো না ! ইরানি জনগণের কোনো অবস্থাই ছিলো না তাদেরকে প্রতিহত করার। আমেরিকানরা যা খুশি তাই করতে পারতো। সেখানে তেহরানে মার্কিন দূতাবাস আমি দেখেছি। একরের পর একর এলাকা নিয়ে তেহরানের মাঝখানে সেই দূতাবাস। সেখানে খুব সহজেই তারা হেলিকপ্টার ল্যান্ড করাতে পারত, দু-একটা প্রাণক্ষয় হলেও বন্দীদের মুক্ত করে নিয়ে যেতে পারতো। তাদের প্ল্যান খুব সুপরিকল্পিতও ছিলো। কিন্তু জানেন কী হয়েছিলো ? দূর্যোগ, দুর্ভোগ। ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে তারা। ইমাম খোমেইনীকে বলা হলো কী ঘটেছে সেখানে। তিনি সুবহানআল্লাহ বললেন না, আলহামদুলিল্লাহ বললেন না। আপনারা জানেন তিনি কী বলেছিলেন ? তিনি কুরআন থেকে উদ্ধৃতি করলেন : “আপনি কি দেখেননি আপনার পালনকর্তা হস্তীবাহিনীর সাথে কীরূপ ব্যবহার করেছেন ?” (সূরা ফীল, ১০৫:)
এই কথাগুলোই তিনি বলেছিলেন। আমি বললাম না তিনি একজন কুরানিক কম্পিউটার !

বিশাল হেলিকপ্টারগুলোকে তারা কী বলে জানেন ? জাম্বো হেলিকপ্টার। বড় বড় প্লেনগুলোকে জাম্বো প্লেন বলা হয়। সোয়াহিলিতে জাম্বো বলতে হাতি বুঝায়। এখান থেকেই তারা জাম্বো শব্দটি পেয়েছে। তো, এই হাতির মত হেলিকপ্টারগুলো সেখানে গেলো (ধ্বংস হলো), এবং ইমাম বললেন : “আপনি কি দেখেননি আপনার পালনকর্তা হস্তীবাহিনীর সাথে কীরূপ ব্যবহার করেছেন ?”

কিন্তু আমরা এত সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, মুসলিম দুনিয়া এত সন্দিগ্ধ যে আমরা কুরআনে আর বিশ্বাস করি না ! আমরা সত্যিই কুরআনে বিশ্বাস করি না ! বেশিরভাগ মানুষের কাছে এটা হলো এক প্রকার এন্টারটেইনমেন্ট ! মাশাআল্লাহ, আধ্যাত্মিক অনুভূতি পাওয়া যায় কুরআন আবৃত্তির মাধ্যমে, আত্মিক উন্নতি; কিন্তু যে নির্দেশনা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে দিয়েছেন – কেউ না, কেউ সেটা কেয়ার করছে না। আল্লাহ আমাদের এই (দ্বীনি) ভাইদেরকে মুসলিম ও অমুসলিম বিশ্বের জ্ঞান গবেষণা ও আলোর দিশারী হবার তৌফিক দিন। আর এই জাতিটাই এই কাজের জন্য প্রস্তুত, মুখিয়ে আছে। যখন আপনি তাদেরকে দেখবেন, তাদের যে নিষ্ঠা... একটা নির্ভীক জাতি। আমিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যখন দেখলাম তারা বলছে : “মার্গ বার আমরিকা” (আমেরিকা ধ্বংস হোক), “ধ্বংস হোক রাশিয়া”, "ধ্বংস হোক ইসরাঈল"। কল্পনা করতে পারেন (হাসি) ? একটা জাতি এই কথা বলছে, এবং টিকে আছে ! আর তারা ন্যূনতম ভীত নয়। সলামী চেতনা-ই তাদের চিন্তা-চেতনাকে উজ্জীবিত করছে। তারা ইরান কিংবা ইরানি বিপ্লব সম্পর্কে কথা বলছে না। যখনই ইরানিয়ান শব্দটা শুনবেন, দেখবেন তারা একটি ইসলামী বিপ্লবের কথা বলছে, শুধু ইরানি বিপ্লবের কথা নয়। এটা ইসলামের জন্য বিপ্লব, ইরানের জন্য বিপ্লব নয়। এটা ইসলামের বিপ্লব ! এটা খুব একটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে দুনিয়ার জাতিগুলো এই ইরানকে সহ্য করতে পারছে না।

তো, প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমি আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের অনেকটা ইতিমধ্যে নিয়ে নিয়েছি। এই কথার মাধ্যমে আমি বক্তব্য শেষ করছি এবং প্রশ্ন-উত্তর পর্বের জন্য সুযোগ করে দিচ্ছি।

আহমদ দীদাত
মার্চ ৩, ১৯৮২।
সাউথ আফ্রিকা।

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন।)

(লেখাটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে নিচের লেখাগুলি পড়তে পারেন।)
ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস
জিহাদ আল আকবার : নফসের সাথে যুদ্ধ
শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী। বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি , যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো , এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র - পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে , বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো , তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?