গত দুই মাস যাবৎ একটা বিষয় আমি খুব ভেবেছি। তা হলো, আমরা কিভাবে আমাদের স্বপ্নগুলোকে বুনি। প্রথমে আমরা অনেক বড় একটা স্বপ্ন দেখি: যা পেতে চাই, বা যেখানে যেতে চাই। তারপর একটু একটু করে সেই লক্ষ্যে কাজ করতে থাকি। এরপর একটা সময় স্বপ্নটা পূরণ হয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে আমরা নতুন স্বপ্নের পিছনে ছোটা শুরু করি। তাই যে স্বপ্নটা এত সাধনার পর আজকে পূরণ হচ্ছে, সেটা উপভোগ করা কিংবা তার জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরও সময় পাই না -- আমি যে নতুন স্বপ্নের পিছনে ছুটছি!
অথচ মানুষের জীবনটা কত দুর্বল, কত নাজুক! মাথায় একটুখানি আঘাত পেয়ে, ঠাট্টাচ্ছলে বন্ধুর ধাক্কা বুকে লেগে, অকস্মাৎ গাড়ির আঘাতে কিংবা শত স্বপ্ন বয়ে নেয়া প্লেনটা ক্র্যাশ করে -- মুহুর্তেই আমরা শেষ হয়ে যাই! মৃত্যু এসে গেলে, কিংবা ব্রেইনটা আর ঠিকমত কাজ না করলে স্বপ্ন বোনা বন্ধ হয়ে যায়। প্রেম, ভালোবাসা, হাসি-আনন্দ-গল্প -- মুহুর্তে সব শেষ হয়ে যায়।
কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই আত্মপ্রতারণা করে। “এটাই জীবনের নিয়ম, দুনিয়াটা এমনই, মৃত্যু আসলেতো আসবেই” এজাতীয় নানান কথা দিয়ে মৃত্যুর গল্পগুলোকে সরিয়ে রাখে। কেউ মৃত্যুর গল্প করে না। কারো স্বপ্ন বোনায় মৃত্যুর পার্ট থাকে না। এভাবেই আমরা স্বপ্ন বুনে চলেছি, আর এভাবেই সবাই আমাদেরকে স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছে।
পড়াশুনা, ভালো জব, বিয়ে, বন্ধু-আড্ডা-ট্যুর, মোটামুটি টাকা পয়সা, আরামের জীবন, সুন্দর সংসার -- এই গল্প আমার বানানো না। এটা খুব কমন একটা স্বপ্ন -- আমরা সবাই-ই এই স্বপ্ন দেখতে শিখে গেছি। এই স্বপ্ন দেখতে আমাকে কোনো কষ্ট করতে হয়নি। আর কী চমৎকার, দেখেন! এই স্বপ্নগুলোর একটার সাথে আরেকটার কত মিল! ভালো পড়াশুনা করলে ভালো ক্যারিয়ার মিলবে, ভালো জবে ভালো স্যালারি, বন্ধুদের আড্ডাও তখন সুমধুর আর সংসারেও আরাম আয়েস। আল্লাহ এত সুন্দর সবকিছু দিলেন, কিন্তু দুনিয়ার গল্পে আরেকটা এলিমেন্ট দিয়ে দিলেন: মৃত্যু। আর সে স্বপ্ন বোনার যেকোনো পর্যায়ে এসে বাগড়া দেবে -- সবকিছু থামিয়ে দেবে। এ এমন এক এলিমেন্ট, যা কোথাও খাপ খায় না। কোনো গল্পেই না। এমনকি বৃদ্ধ দাদুরও নতুন স্বপ্ন বোনা থামে না: নাতি নাতনির সাথে আরো ক’টা দিন হাসি আনন্দে কাটাতে চায়! কোনো গল্পেই না, কোনো স্বপ্নেই না -- কোথাও-ই মৃত্যুটা খাপ খায় না, অথচ সে সবার গল্পে জোর করে আসবেই।
আমি ভেবেছি, এই সমস্ত গল্পের মাঝে আল্লাহ কেন মৃত্যুর মত একটা এলিমেন্ট দিলেন: যে সকল স্বপ্নকে নষ্ট করে দেয়! দুনিয়া নিয়ে আল্লাহর প্ল্যানটাই কি তবে অসুন্দর-অপূর্ণ-ভুল, নাকি আমরাই মৃত্যুটাকে গল্পের কোথায় বসাবো, তা বুঝতে পারছি না?
………………...............................................................
টুকটাক লেখালেখি করি ছোটবেলা থেকেই; তারপর ইন্টারনেট পেয়ে ব্লগে, ফেইসবুকে, এখানে-সেখানে...। আমি জানি আমি ভালো লিখতে পারি না। তবুও এলোমেলো যা-ই লিখি, কাছের মানুষজন তা পড়ে। কিংবা দু-দশটা মানুষের সাথে গল্পের মাঝে যখন নানান তত্ত্বকথা বলি, প্রিয়জনেরা তা শোনে। তারপর কে যেন আমাকে লিখে দিলো: ভালো থাকবেন, কথার জাদুকর...। আমি তাই আমার কথাগুলি নিয়ে আর কাছের মানুষগুলিকে নিয়ে গল্প রচনা করতাম। কত সুন্দর সুন্দর সে গল্প! স্বপ্নের চেয়েও বড়। সেসব কথা কখনো বলা হয়নি, লেখা হয়নি। আমাদের ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে তা সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে হৃদয়ের মণিকোঠায় সুরক্ষিত হয়ে আছে।
কিন্তু মৃত্যুর গল্পটা কারো সাথে করা হলো না। কেউ আমাকে বলল না, মৃত্যুটাকে গল্পের কোন জায়গায় বসাতে হবে! আর সেকথা আমি লিখব কী -- আমিতো নিজেই জানি না!
মৃত্যু আর পরকাল নিয়ে টিপিকাল ধর্মীয় আলাপ আমার ব্রেইন পর্যন্ত পৌঁছেছে বটে, কিন্তু আমাকে শিখায়নি আমার স্বপ্ন বোনার সাথে কিভাবে তাকে খাপ খাওয়ানো যাবে : গল্পের কোন জায়গায় মৃত্যুকে বসালে সে আর অনাকাঙ্খিত থাকবে না!
এই গল্প রচনায় আমি তখন সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছি। আমি কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি, কাউকে বলিনি। আর বললেই বা - তারাওতো আমার মতনই ক্লু-লেস! কেবল তারা মৃত্যু ভুলে চলছে, আর আমি স্বপ্ন বুনতে বুনতে এই জায়গায় ঠেকে গিয়ে সমাধান খুঁজছি - গল্পের ঠিক কোন জায়গায় মৃত্যুটাকে বসাবো! আমার এত স্বপ্ন, এত গল্প -- মৃত্যুকে তা নষ্ট করে দিতে পারি না!
মৃত মানুষের মতনই একাকী হয়ে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। আর সেটা আমার জীবনে নতুন এক গল্প রচনা করে দিয়ে গেছে! কিন্তু সে গল্প আমি কা’কে বলব? কে শুনতে চায় এসব গল্প? কে আছে যে আমার সাথে পাশাপাশি হেঁটে এমন এক স্বপ্ন বুনবে, যেখানে মৃত্যুও তার নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে গল্প রচে গেছে...। যে স্বপ্ন ছোট ছোট চাওয়া পাওয়াগুলি পেরিয়ে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তারপরও থামে না; অনন্তের পথে যাত্রা করে!
আমার ছোট্ট একটা জগত। কিন্তু খুব ইচ্ছা করে, সে জগতের সবাইকে নিয়ে সেই পথে হাঁটি! স্বপ্ন বোনা শিখাই, অনন্তের গল্প লিখি!
…………………………………………………………………….
বহুদিন পর দেশে ফিরছি। কতদিন পর, কে জানে?
But this time I have a different story to tell.
Dear all, please bear with me.
The plane is about to take off.
নূরে আলম
জানুয়ারি ২৭, ২০১৭।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
[ব্লগে কমেন্ট পোস্ট করার পরও যদি না দেখায়, তাহলে দ্বিতীয়বার পোস্ট করার প্রয়োজন নেই। খুব সম্ভবত স্প্যাম গার্ড সেটাকে সরিয়ে নিয়েছে, আমি পাবলিশ করে দেবো।]